অভিমত

চিন্তক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান : নতুন ধারার সমাজতান্ত্রিক ভাবনা

তাপস দাস :


বর্তমান বিশ্বরাজনীতিতে চলে আশা বৈষম্য যেন শেষ দেড় বছরে করোনা পরিস্থিতিতে চরম সীমা অতিক্রম করেছে। পুঁজিবাদী সমাজ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে একটু মুচকি হাসছে। সাধারণ মানুষ হয়তো সম্প্রতি তাদের জীবন নিয়ে এতটা আতঙ্কে দিন কাটায়নি। তাত্ত্বিকরা পুঁজিবাদের জাল কাটতে আজ তাদের গুটি সাজিয়ে চলেছেন একদিন ভালো সময় আসার অপেক্ষায়। যখন ক্লান্ত হয়ে পড়েন তখন প্রশান্ত মহাসাগরের সুদূর প্রান্তে কোনো দেশ থেকে ভেসে আসা খবরে তারা জেগে ওঠে এই হয়তো সমাজতন্ত্র আর কিছুদিনের অপেক্ষায়।
চে গুয়েভারা ঘুরে বেড়ায় মানুষের ফ্যাশনে, আমার মনে প্রশ্ন ওঠে আচ্ছা শেখ মুজিব নয় কেন? মুসলিম ছিলেন বলে নাকি বাঙালি? নাকি তৃতীয় বিশ্বের কেউ বলে যেমনটি সত্যেন বোসের নোবেল প্রাপ্তি ঘটেনি। সে কারণ যাই হোক না কেন, আমি এই লেখার মধ্যে দিয়ে বোঝার চেষ্টা করবো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাজতন্ত্রের ধারণা পূর্বের যে কোনো ধারণার থেকে কতটা স্বতন্ত্র।

তবে আলোচনার শুরুতে একটি কথার উত্তর পরিষ্কার করে নিতে চাই, অনেকের মতে মুজিবের সমাজতান্ত্রিক এবং ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তা ভারতীয় রাজনীতি দ্বারা প্রভাবিত। এক্ষেত্রে বলে রাখি, বাংলাদেশ ভারতবর্ষের আগে সংবিধানের মূলনীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষ এবং সমাজতন্ত্র শব্দদ্বয় যুক্ত করেছে। আরো গভীরভাবে এর উৎস নিয়ে প্রয়াত অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেছেন, “সমাজতন্ত্রের কথাটা প্রথম সুস্পষ্টরূপে উচ্চারিত হয় ১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র-সম্পর্কিত প্রথম জাতীয় সম্মেলনে। সোহরাওয়ার্দী-শরৎ বসুর পরিকল্পনায় অখণ্ড বঙ্গের ভাবী রাষ্ট্রকে যেমন সোশালিস্ট রিপাবলিক বলে আখ্যায়িত করা হয়েছিল, মনে হয় তারই অনুকরণে সেখানে গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয় যে, United States of Pakistan Shall Be a Socialist Republic অর্থাৎ একইসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রীয় ও সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা দাবী করা হয়েছিল। ১৯৪৮ সালে গণতান্ত্রিক যুবলীগ বিদেশী পুঁজি বাজেয়াপ্ত করার এবং বড় শিল্প, ব্যাঙ্ক ও বীমা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের প্রস্তাব করে। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগ চায় প্রধান প্রধান শিল্পের জাতীয়করণ। যুক্তফ্রন্টের একুশ দফায় পাটশিল্প জাতীয়করণের প্রতিশ্রুতি ছিল।” ৫০-এর দশকে চীন সফরে, একটি সম্মেলনে বলেছিলেন, আমি নিজে কমিউনিস্ট নই। তবে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে বিশ্বাস করি না। একে আমি শোষণ যন্ত্র হিসেবে মনে করি। এই পুঁজিপতি সৃষ্টির অর্থনীতি যতদিন দুনিয়ায় থাকবে ততদিন মানুষের ওপর থেকে শোষণ বন্ধ হতে পারে না।

১৯৬৯ সালের ১১ দফাতেও ব্যাংক-বীমা-পাটশিল্প জাতীয়করণের কথা বলা হয়। অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাকল্পে সমাজতন্ত্র কায়েমের কথা বলা হয় ১৯৬৯ সালে আওয়ামী লীগের প্রচারিত নীতি ও কর্মসূচিতেও। বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে বলেছিলেন, ‘এদেশকে আমরা গড়ে তুলব। এদেশের মানুষ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে।’

শুধু মুক্তিযুদ্ধের আগে নয়, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও সোনার বাংলা কিভাবে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হবে তা তিনি একাধিক বক্তৃতায় এবং কর্মকান্ডের মধ্যে দিয়ে তার রূপরেখার কথা বলে গেছেন। ১৯৭২ সালের ১৯ মে বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি- ন্যাপের জাতীয় সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু এ কথা বলেন। সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘আড়তদার, মজুতদার, মুনাফাখোর চোরাকারবারিদের বিরুদ্ধে শিগগিরই কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। এদেরকে অবশ্যই চরম আঘাত হানা হবে। এরা পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়ে দেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করার বিষয়ে তৎপর রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘জনগণ শক্তির উৎস। দেশের মানুষ এদের প্রতিরোধ করবে।’ বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি গ্রহণ করেই অর্থনৈতিক স্বাধীনতা আনতে হবে।’

আমাদের দেশের জনগণকে বাঁচাতে হলে সমাজতন্ত্র ছাড়া অন্য কোনও উপায় নেই উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘ব্যক্তিগত মালিকানার সুযোগ দিলে সাময়িকভাবে হয়তো অর্থনীতির ক্ষেত্রে কিছুটা চাকচিক্য দেখা যেতো। কলকারখানা জাতীয়করণের বদলে ব্যক্তিগত মালিকানায় রাখলে চোরাপথে অর্থ সমাগমে এগুলো হয়তো তাড়াতাড়ি চালু হতো এবং কিছু সাময়িক সুবিধে হতো না তাও নয়। অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি দেখা দিতো, কিন্তু একবার দেশে ব্যক্তি মালিকানা স্বীকার করে নিলে পরবর্তী পর্যায়ে তাদেরকে প্রতিহত করা কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ, এদের সঙ্গে দুনিয়ার পুঁজিবাদী গোষ্ঠীর একটি স্বাভাবিক যোগাযোগ গড়ে ওঠে।’ তিনি বলেন, ‘সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য প্রথমে জনতাকে দুঃখ-কষ্ট ভোগ করতে হয়।’

প্রথম স্বাধীনতা দিবস তথা ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চের ভাষণে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘আমার সরকার অভ্যন্তরীণ সমাজ বিপ্লবে বিশ্বাসী। পুরাতন সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন করতে হবে। অবাস্তব তাত্ত্বিকতা নয়। দেশের বাস্তব প্রয়োজনের ভিত্তিতে পুরনো সামাজিক কাঠামো ভেঙে দিয়ে নতুন সমাজ গড়তে হবে।’
১৯৭২ সালের ৯ মে রাজশাহীতে এক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘সমাজতন্ত্র ছাড়া বাংলার মানুষ বাঁচতে পরবে না, সেজন্য সমাজতন্ত্র কায়েম করার উদ্যোগ নিয়েছি। কোনো লোক একশ’ বিঘার ওপর জমি রাখতে পারবে না। উদ্বৃত্ত জমি ভূমিহীনদের মধ্যে বিলি করে দেওয়া হবে।’

কার্ল মার্কসের সমাজতন্ত্র যেখানে সম্পত্তির ব্যক্তি মালিকানাকে উচ্ছেদ করে, সেখানে বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক সমাজতন্ত্রে মালিকানার বিষয়টি অনেকটা ‘রাশিয়ার চিঠি’ গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ উল্লেখিত সম্পত্তি মালিকানার মতো। ‘ব্যক্তিগত সম্পত্তি থাকবে অথচ তার ভোগের একান্ত স্বাতন্ত্র্যকে সীমাবদ্ধ করে দিতে হবে।’
১৯৬১ সালে জমির ঊর্ধ্বসীমা পাকিস্তানি সামরিক শাসকরা বাড়িয়ে ৩৭৫ বিঘা করেছিল, ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু তা হ্রাস করে ১০০ বিঘা করেন। এর ফলে উদ্বৃত্ত হওয়া খাস জমি ভূমিহীন কৃষকদের মাঝে বিতরণ করে বঙ্গবন্ধু সম্পদ বৈষম্য হ্রাসে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। সংবিধানের ১৩(ক)(খ)(গ)-তে সম্পদের যথাক্রমে রাষ্ট্রীয়, সমবায়ী ও ব্যক্তিগত মালিকানার বিধান রেখে সব শ্রেণির মানুষের সম্পদ অর্জনের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে।

মুজিবের সমাজতন্ত্রের চিন্তাধারা কার্লমার্ক্সের চিন্তা থেকে আলাদা ছিল তাই নয়, দুবারের চীন সফরে গিয়ে তার মনে প্রশ্ন জেগেছিলো, কমিউনিস্ট বা সমাজতান্ত্রিক দেশে মানুষ কি স্বাধীন? তাত্ত্বিকরা কম্যুনিজম বা সোশ্যালিজমের যে কাঠামো তৈরি করেছেন, মানুষকে কি হুবহু সেই ফ্রেমে আটকানো যায়? তার উত্তর ছিল- না। তার নয়াচীন বইয়ের শেষে তিনি বলেছেন, চীন তাকে মুগ্ধ করেছে কিন্তু সেখানে “অন্য কোনো নতুন আদর্শের দল সৃষ্টি করার অধিকার কারো নেই।” সুতরাং তিনি এমন একটি সোশ্যালিস্ট কাঠামোর কথা বলেছেন যেখানে অন্যান্য মতাদর্শকে গুরুত্ব দেওয়া হবে। নিঃসন্দহে সোশ্যালিজম এর আলোচনায় এটি একটি নতুন তত্ত্ব ধারণা, যেটি নিয়ে এখনো সেভাবে আলোচনা করা হয় না। তিনি শুধু মতাদর্শগত স্বাধীনতার কথা বলেননি, তিনি মানুষের স্বাধীনতার কথাও বলেছেন। সাধারণত উদারনৈতিক মতবাদে ব্যক্তিস্বাধীনতার কথা বলেও সোশ্যালিজম মতবাদের মধ্যে থেকে মানুষের মুক্তির পথ দেখিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি বলেছেন, “ভাত-কাপড় পাবার ও আদায় করে নেবার অধিকার মানুষের থাকবে। সাথে সাথে নিজের মতবাদ প্রচার করার অধিকার মানুষের থাকা চাই। তা না হলে, মানুষের জীবনবোধ পাথরের মতো শুষ্ক হয়ে যায়। ”

শেখ মুজিবুর রহমান যে শুধু তার রাজনৈতিক কাজকর্মের মধ্যে সোশ্যালিজমের চিন্তাকে সীমায়িত করেছেন তাই নয়, তিনি তার সমাজতন্ত্রের আদলে বাংলাদেশকে গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন, তাই বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানের মূল নীতিগুলির মধ্যে জায়গা করে নিয়েছিলো সমাজতন্ত্র। ১৯৭২ সালের ৪ই নভেম্বর বাংলাদেশ গণপরিষদে খসড়া অনুমোদন উপলক্ষে শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন, “আমাদের সমাজতন্ত্র মানে শোষণহীন সমাজতন্ত্র, সমাজতন্ত্র আমরা দুনিয়া থেকে হাওলাত করে আনতে চাই না। এক-এক দেশ এক-এক পন্থায় সমাজতন্ত্রের দিকে এগিয়ে চলেছে। সমাজতন্ত্রের মূল কথা হলো শোষিতের সমাজতন্ত্র।”
বর্তমানে অ-পশ্চিমি তত্ত্ব রচনার একটি ধারা গড়ে তুলেছে চীন, জাপান এবং ভারতীয় তাত্ত্বিকরা কিন্তু বাংলাদেশ গড়ে ওঠার পিছনে যে নতুন মৌলিক তত্ত্ব গড়ে উঠেছিল তা নিয়ে কাউকে মাথা ঘামাতে দেখা যায়নি। কোথায় আছে বিশ্বরাজনীতিতে যে রাষ্ট্র শক্তিধর তাদের চিন্তায় বৌদ্ধিক জগৎ অধিকার করে থাকে সেক্ষেত্রে পশ্চিমি রাষ্ট্রচিন্তা আজও আমাদের মনোন জুড়ে আছে। বর্তমানে অ-পশ্চিমি রাষ্ট্র চিন্তা গড়ে উঠলেও বাংলাদেশকে সেভাবে গুরুত্বই দেওয়া হয়নি কিন্তু বাংলাদেশ একমাত্র দক্ষিণ এশিয়ার দেশ যারা সংবিধানে সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতাকে মূলনীতিতে জায়গা করে দিয়েছে।
সুদীপ কবিরাজ তার একটি লেখায় বলেছিলেন, “রাশিয়ায় বৃষ্টি হলে পশ্চিমবঙ্গের কমরেডরা কলকাতায় ছাতা খোলে”। সে অর্থে মুজিবের সমাজতান্ত্র চীন, সোভিয়েত রাশিয়াসহ যে কোনো দেশের থেকে আলাদা। আমরা সবাই সর্বহারা সমাজতন্ত্রের কথা শুনেছি, কিন্তু মুজিবের ‘শোষণহীন সমাজতন্ত্র’। অনেকেই বলতে পারেন, মুজিবের সমাজতন্ত্র অচিরেই মুখথুবড়ে পড়েছিল। তবে আমার লেখার উদ্দেশ্য সেটা নয়, আমি সমগ্র আলোচনার মধ্যে দিয়ে বোঝাতে চাইছি আমাদের চিন্তার রক্ষণশীলতা কাটিয়ে মুজিবের সমাজতন্ত্র নিয়ে আলোচনার সময় এসেছে।

তথ্যসূত্র:
বাংলাদেশের সংবিধান।
আনিসুজ্জামান, ২০১৭, বাঙালি এবং বাংলাদেশ, কলকাতা: মিত্র ও ঘোষ।
শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, ঢাকা: ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড।
নাসের মোহাম্মদ, ২০২০, “বঙ্গবন্ধু বৈষম্যহীন সমাজভাবনা” যুগান্তর, ডিসেম্বর ১৮, ২০২০।
মুনতাসির মামুন, ২০২০, “বঙ্গবন্ধু, নয়াচীন এবং সমাজতন্ত্র: সাম্যবাদ”।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, no. ২৩২ (ফেব্রুয়ারি), ৩৩-৩৪।
উদিসা ইসলাম, ২০২০, “সমাজতন্ত্র ছাড়া কোনও উপায় নেই : বঙ্গবন্ধু”, বাংলা ট্রিবিউন, মে ১৯, ২০২০।

লেখক: গবেষক, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, কলকাতা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *