নিজস্ব প্রতিবেদক, ধূমকেতু ডটকম: ওষুধের অপব্যবহার বিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস পালিত হচ্ছে আজ শনিবার (২৬ জুন)। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, অপব্যবহার করা হলে জীবনরক্ষাকারী ওষুধই হয়ে উঠতে পারে জীবননাশী বিষ। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ গ্রহণ করা উচিত হবে না। আর চিকিৎসকেরও দায়িত্ব হবে রোগীকে সঠিক প্রেসক্রিপশন প্রদান করা। এভাবে চিকিৎসক ও রোগী উভয়ই দায়িত্বশীল ও সচেতন হলে ওষুধের অপব্যবহারের ঝুঁকি অনেকাংশে হ্রাস পাবে। পাশাপাশি ভেজাল ও মানহীন ওষুধ উৎপাদনকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানসমূহের মূলোৎপাটন করতে হবে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, অসুখ হলে ওষুধ খেতে হয়—এ কথা আমরা সবাই জানি। কিন্তু সঠিক নিয়মে ওষুধ খাওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনেকেই অনুভব করি না। ওষুধ খেতে আমরা যতটা তৎপর, ওষুধ খাওয়ার নিয়ম মানতে ততটাই উদাসীন। আমাদের এই অবহেলা জীবন রক্ষাকারী ওষুধকে করে তুলতে পারে জীবনবিনাশী বিষ।
ওষুধ গ্রহণের ক্ষেত্রে আমরা প্রথমেই যে অনিয়মটা করি, তা হলো চিকিৎসকের পরামর্শ না নেওয়া। আমরা নিজেরাই নিজেদের চিকিৎসা করি, কখনো আত্মীয়, কখনো বন্ধুর পরামর্শ নিই, কখনো চিকিৎসকের চেয়ে ওষুধ বিক্রেতার ওপর বেশি নির্ভর করি। ‘অমুক ওষুধে তমুক ভালো হয়েছিল, তাই আমিও ভালো হব’ এমন চিন্তা আমাদের মধ্যে কাজ করে। অথচ, লক্ষণ এক হলেই অসুখ এক হবে এমন কোনো কথা নেই। আবার একই রোগে একই ওষুধের মাত্রা রোগীভেদে ভিন্ন হতে পারে। অনেক ওষুধের মারাত্মক, কখনো জীবনবিনাশী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে আমরা সম্পূর্ণ অজ্ঞ।
এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডীন অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ ধূমকেতু ডটকমকে বলেন, যদিওবা কখনো (বাধ্য হয়ে) চিকিৎসকের পরামর্শ নিই, ওষুধ ব্যবহারের ক্ষেত্রে চিকিৎসকের বেঁধে দেওয়া বিধিনিষেধ মানি কম। সময়মতো ওষুধ খাওয়া, খাওয়ার আগে, না পরে তা বুঝে খাওয়া, পর্যাপ্ত পানি পান করা, এসব আমরা খেয়াল রাখি না। বিশেষ করে অ্যান্টিবায়োটিকের মাত্রার ক্ষেত্রে আমরা পুরোপুরি উদাসীন থাকি। সবচেয়ে ভয়াবহ হলো ওষুধ বন্ধ করে দেওয়া। ‘জ্বর ভালো হয়ে গেছে, অ্যান্টিবায়োটিক আর কী দরকার’ ভেবে নিজেরাই ওষুধ বন্ধ করে দিই। আবার অন্যদিকে কয়েক দিনে জ্বর ভালো না হলে ‘ওষুধ ঠিক নাই’ ভেবে তা বন্ধ করে দিই এবং অন্য চিকিৎসকের কাছে নতুন ওষুধের প্রত্যাশায় যাই। যেসব অসুখে দীর্ঘদিন বা আজীবন ওষুধ খেতে হয়, সেখানে আমরা অসুখ নিয়ন্ত্রণে এলেই তা বন্ধ করে দিই, বুঝতে চাই না যে রোগ ভালো হয়নি, নিয়ন্ত্রণে আছে কেবল। একসময় লোকমুখে ‘ক্যানসারের ওষুধ’ শুনে বাতের ওষুধ বন্ধ করার ঘটনা প্রচুর দেখা যেত। ওষুধ শুরুর মতো বন্ধ করার সময়ও আমরা নিয়ম মানি না। যেসব ওষুধ হঠাৎ বন্ধ করা যায় না, তা নিজেরাই হঠাৎ বন্ধ করে দিই।
অধ্যাপক এবিএম আব্দুল্লাহ আরও বলেন, যে রোগের জন্য ওষুধ সেবন করা তার উপশম হবে না, বরং খারাপ হতে পারে। ওষুধ প্রতিরোধী জীবাণুর আবির্ভাব এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার জীবাণুর বিরুদ্ধে এদের অকার্যকর করে দিচ্ছে। সঠিক অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে যে রোগ শুরুতেই ভালো করা যেত, অপব্যবহারের কারণে তা আর সম্ভব হচ্ছে না, নতুন দামি ওষুধ দরকার হচ্ছে, কখনো তাতেও কাজ হচ্ছে না। শুধু জীবাণু সংক্রমণ নয়, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ইত্যাদি অসুখেও মাঝে মাঝে ওষুধের ব্যবহার উপকারের চেয়ে অপকারই বেশি করে।
নিয়মিত ওষুধ খেলেও যদি সেবনবিধি না মানা হয়, তবে অনেক ওষুধই অকার্যকর হয়ে যায়। খালি পেটে খাওয়ার ওষুধ ভরা পেটে খেলে তা না খাওয়ার মতোই হবে। এ ছাড়া অনেক ক্ষেত্রেই এক ওষুধ অন্য ওষুধের উপস্থিতিতে কাজ করে না। অজ্ঞ ব্যক্তির পরামর্শে এসব ওষুধ একত্রে খেলে লাভ তো হবেই না, বরং ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা আছে।
মনের মতো ওষুধ খাওয়ার আরেক সমস্যা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। একজন চিকিৎসক ভালোমতোই জানেন, কোন ওষুধের কী সমস্যা আর তাই তা কাকে দেওয়া যাবে, কাকে যাবে না। নিজে থেকে ওষুধ খেলে এসব বিবেচনা সম্ভব নয়, তাই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার আশঙ্কা বেশি বলে জানান অধ্যাপক এবিএম আব্দুল্লাহ।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. সাইফুল্লাহ রাসেল বলেন, চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া সাধারণ সর্দি-কাশিসহ বিভিন্ন ছোটো খাটো রোগের ক্ষেত্রে অনেকেই নিজে নিজেই রোগ নির্ণয় ও ওষুধ সেবন করে থাকেন। এটা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি। শরীরে বাসা বাঁধতে পারে জটিল ও ভয়ঙ্কর রোগ।
তিনি আরও বলেন, আমাদের শরীরে যখন কোনো রোগের উপসর্গ দেখা দেয়, তখন আমরা নিজেরাই রোগ নির্ণয় করি। একজন স্বাভাবিক ব্যক্তি তার শরীরের রোগের উপসর্গ বুঝে অনভিজ্ঞ ফার্মেসি দোকানদারের কাছ থেকে ওষুধ কিনে সেবন করেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ওই ওষুধগুলো বেদনানাশক হয়ে থাকে। এতে সাময়িক কিছুটা উপকার হলেও শরীরে দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা দেখা দিতে পারে।