অভিমত

ঘৃণিত নরপশুদের দ্রুত বিচার আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি চাই

তাপস হালদার:
নরপশুদের ধিক্কার, ঘৃণা জানানোর কোনো ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। যে কোনো ঘৃনা প্রকাশই তাদের জন্য কম হয়ে যাবে। নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে একজন নারীর উপর যে পৈশাচিক নির্যাতন করা হয়েছে সেটা দেখে একজন পুরুষ হিসেবে আমি লজ্জিত!

মানুষের বিবেকবোধ কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে সেটা ভাবতে পারি না। কয়েকদিন আগে সিলেটে এমসি কলেজে নবপরিণীতা স্ত্রীকে নিয়ে ঘুরতে গিয়ে স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে গণধর্ষণ, সাভারে প্রেমের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় স্কুলছাত্রী খুন, ঝিনাইদহে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া একজন ছাত্রীকে পরিবারের উপর প্রতিশোধ নিতে নিজ ঘরে ধর্ষণ করে হত্যা, রাজশাহীতে একজন চার্চ প্রধান কর্তৃক স্কুলপড়ুয়া ছাত্রীকে চার্চের ভিতর দিনের পর দিন আটক করে ধর্ষণ- এ রকম অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে। অনেক ঘটনা হয়তো প্রকাশও পাচ্ছে না।

আরও পড়ুন: আমি বঙ্গবন্ধুর মেয়ে

ধর্ষণ আজ সামাজিক ব্যাধি ক্যান্সারের মতো ছড়িয়ে পড়ছে। ধর্ষকের লোলুপ দৃষ্টি থেকে বৃদ্ধ, শিশু থেকে প্রতিবন্ধী এমনকি বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী পর্যন্ত কেউই রেহাই পাচ্ছে না। ধর্ষণের পর হত্যা করার মতো ভয়াবহ প্রবণতাও দিন দিন বেড়েই চলছে। সমাজের প্রতিটি স্তরে ছড়িয়ে পড়ছে। মানুষের সভ্যতা যত এগিয়ে যাচ্ছে ধর্ষণের মাত্রাও মনে হয় দিন দিন ততই বেড়ে যাচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় উপাসনালয়, রাস্তাঘাট, বাস, লঞ্চ, বাজার এমনকি নিজ বাড়িতেও নারীরা নিরাপদ থাকতে পারছে না। যেখানেই সুযোগ পাচ্ছে নরপশুরা ঝাঁপিয়ে পড়ছে।

কেন ঘটছে এই মানবতার বিপর্যয়? আকাশ সংস্কৃতি, সামাজিক অস্থিরতা, মাদকের ভয়াবহতা, নাকি বিচারের দীর্ঘসূত্রতা? কারণ যেটিই হোক এর ভয়াবহতা যে দিন কে দিন বেড়েই যাচ্ছে, সেটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।

মনোবিজ্ঞানী মোহিত কামাল এ প্রসঙ্গে বলেছেন, আমাদের প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের বিবেক। বিবেক কে ছাপিয়ে যখন প্রবৃত্তি প্রভাব বিস্তার করে তখন ভোগবাদী সত্তা আধিপত্য বিস্তার করে। প্রথমত তারা অবনমিত কাম চরিতার্থ করতে চায়। দ্বিতীয়ত, নারীর প্রতি প্রভুত্ব বা ক্ষমতা দেখাতে চায়। তৃতীয়ত, নারীকে ভোগ্যপণ্য মনে করে। নারী যে বোনের মমতা, মায়ের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধায় মেশানো একজন মানুষ সেটা এদের মন থেকে সরে গিয়ে ভোগের বস্তুতে পরিণত হয়েছে।

বাংলাদেশে ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি আইনে কী বলা হয়েছে সে বিষয়টা একটু দেখা যাক। বাংলাদেশে ধর্ষণের বিচার হয় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে। আইনের ৯ ধারায় বিচারের শাস্তি হিসেবে বলা হয়েছে- # ধর্ষণের ফলে কোনো নারী বা শিশুর মৃত্যু হলে তার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড # একাধিক ব্যক্তি দলবেঁধে ধর্ষণ করলে তার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড # ধর্ষণের ফলে কোনো নারী বা শিশু আহত হলে তার শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড # ধর্ষণের চেষ্টা করলে অনধিক ১০ বছর ও সর্বনিম্ন পাঁচ বছরের কারাদণ্ড # পুলিশ হেফাজতে থাকা অবস্থায় ধর্ষণের শিকার হলে অনধিক ১০ বছর ও ন্যূনতম পাঁচ বছরের কারাদণ্ড।

এত কঠিন শাস্তির পরও কেন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নির্যাতিতা নারী বিচার পায় না তার মূল কারণ বাংলাদেশের আইনে যিনি ধর্ষিত হন সেই মা কিংবা বোনকেই প্রমাণ করতে হয় তিনি ধর্ষিত হয়েছেন। এই প্রমাণ করাটা অনেক সময়ই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। যথা সময়ে শারীরিক পরীক্ষা করা না হলে ধর্ষণ প্রমাণ ও বিচার পাওয়া কঠিন হয়ে যায়। আইনি লড়াইয়ের জন্য সার্টিফিকেট খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে জরুরী ভিত্তিতে পরীক্ষা করতে হয়। কিন্তু সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক কারণে অনেক ক্ষেত্রেই সময়ক্ষেপণ হয়। তখন অপরাধীরা আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বের হয়ে এসে পুনরায় একই অপরাধে জড়িয়ে পড়ে।

যারা আত্মস্বীকৃত ধর্ষক, হাতেনাতে ধরা পড়ে, যারা গণধর্ষণের মত পাষবিক নির্যাতন চালায়, তাদের ক্ষেত্রে দ্রুত বিচার আইনে বিচার এখন সময়ের দাবী। এক্ষেত্রে আইনের কিছুটা সংশোধনও দরকার। এসব ক্ষেত্রে দীঘসূত্রিতার কোনো সুযোগ নেই।

ধর্ষণকারী নিপীড়কের কোনো রাজনৈতিক পরিচয় থাকতে পারে না, ধর্ষককে অপরাধী হিসেবে বিচার করতে হবে। এটা কোনো নারী-শিশুর বিষয় নয়, এটা একটা জাতীয় সমস্যা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বারবার জোরেশোরেই বলেছেন, ধর্ষকদের পরিচয় উন্মোচন করতে হবে। তিনি দলমত না দেখে অপরাধী হিসেবে দেখবার নির্দেশনা দিয়েছেন। এখন বাংলাদেশে কোনো অপরাধীরই দলীয় পরিচয় ব্যবহার করে পার পাওয়ার সুযোগ নেই। যে বা যিনিই অপরাধ করছেন তাকেই বিচারের আওতায় আসতে হচ্ছে।

ধর্ষণের প্রকোপ বন্ধ করার জন্য বিচার ব্যবস্থাই একমাত্র উপায় নয়, এটা প্রধান উপায়। আমাদের আরো গভীরভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রকে একসাথে কাজ করতে হবে। কারণ খুঁজতে হবে এবং সে অনুযায়ী দীর্ঘমেয়াদী ব্যবস্থা নিতে হবে। এটা যে শুধু বাংলাদেশেই হচ্ছে তা নয়, এই উপমহাদেশেই ক্যান্সারের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। যদি বিচার ব্যবস্থাই একমাত্র পথ হত তাহলে ভারতের দিল্লির নির্ভয়া হত্যাকান্ডের বিচারে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার পরও উত্তর প্রদেশের হাথরসের ঘটনা ঘটত না।

একজন ধর্ষক বা যৌন নিপীড়কের কোনো পরিচয় হয় না। তারা কারো বাবা, চাচা, মামা, খালু, ভাই- কোনো কিছুই তাদের পরিচয় নয়। তাদের পরিচয় একটাই তারা ধর্ষক ও নিপীড়ক। সমাজকে সেভাবে দেখতে হবে। একজন নির্যাতিতা নারীর কোনো অপরাধ থাকে না। তাঁর পাশে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে, স্বাভাবিক জীবনযাপনে তাঁকে সহযোগিতা করতে হবে।

বিচার নিশ্চিতকরণের পাশাপাশি সামাজিক আন্দোলনও গড়ে তুলতে হবে। নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের ঘটনার ৩২ দিন অতিবাহিত হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার পর মানুষ জানতে পারলো, প্রশাসন জানতে পারলো। কিন্তু কেন এই এলাকার লোকজন জেনেও এতদিন নীরব ছিল, সেটাও ভাবতে হবে। শুধুমাত্র প্রশাসন দিয়েই ধর্ষণকে সমূলে নির্মূল করা যাবে না। জনগণকে জেগে উঠতেই হবে। জনগণ, সরকার ও রাষ্ট্রের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় পাষন্ডদের নির্মূল করতে হবে। নোয়াখালীর ঘটনাসহ সকল ঘৃনিত নরপশুদের দ্রুত বিচার আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি চাই।

লেখক: সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ ও সাবেক ছাত্রনেতা।

ইমেইল: haldertapas80@gmail.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *