বাংলাদেশে বসবাসরত ৪৫টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জীবনযাপনে যেমন রয়েছে বৈচিত্র্য, তেমনি রয়েছে স্বকীয়তা। তাদের উৎসব, ধর্ম, শিক্ষা, ভাষা প্রভৃতি নিয়ে ধারাবাহিকভাবে লিখছেন ধূমকেতু ডটকম-এর বিশেষ প্রতিবেদক নিখিল মানখিন। প্রকাশিত হচ্ছে প্রতি শনিবার। আজ প্রকাশিত হলো [৫ম পর্ব]। চোখ রাখুন ধূমকেতু ডটকম-এ।
নিখিল মানখিন, ধূমকেতু ডটকম: বাংলাদেশে বসবাসরত ৪৫টি ক্ষুদ্র জাতিসত্বার মধ্যে একটি হলো কোচ। দেশের ময়মনসিংহ, শেরপুর, গাজীপুর ও টাঙ্গাইল জেলার কিছু সংখ্যক উপজেলা এবং ভারতের কয়েকটি রাজ্যে তাদের বসবাস। তারা হিন্দু ধর্মাবলম্বী। তাদের সমাজ মূলত পিতৃপ্রধান, পুত্র সন্তানেরাই সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়। শিক্ষা ও অর্থনৈতিকভাবে অনেক পিছিয়ে পড়েছে কোচ জাতিগোষ্ঠী। তাদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি রয়েছে। তবে তাদের ভাষার নিজস্ব বর্ণমালা নেই। বাংলাদেশে তাদের জনসংখ্যা দশ হাজারের কম।
ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন (টিডব্লিউেএ) কেন্দ্রীয় মহাসচিব স্বর্ণকান্ত হাজং ধূমকেতু ডটকমকে জানান, দেশের ময়মনসিংহ, শেরপুর ও টাঙ্গাইল জেলার বেশ কিছু সংখ্যক উপজেলায় তাদের বসবাস। ভারতের কয়েকটি রাজ্যেও তাদের বসবাস রয়েছে। শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী ঝিনাইগাতী উপজেলার জুকাকুড়া, পানবর, পশ্চিম বাঁকাকুড়া, পূর্ব বাঁকাকুড়া, দক্ষিণ গান্ধিগাঁও, উত্তর গান্ধিগাঁও, ভালুকা, গজনী, হালচাটি, ডেফলাই, নওকুচি, রাংটিয়া, বড় রাংটিয়া, শালচুড়া, নকশী গ্রাম, নালিতাবাড়ী উপজেলার খলচান্দা, সমশ্চুড়া, বুরুঙ্গা, দাওধারা এবং শ্রীবরদী উপজেলার বাবেলাকোনা, হাতিবর, বালিজুড়ি, খাড়ামুড়া গ্রামসহ ২০ গ্রামে বর্তমানে প্রায় চার হাজারের মতো কোচ সম্প্রদায়ের লোকজন বসবাস করেন।
ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলার সালোরা, হাতিল, জয়রামপুর, কিসমতপুর, ঘাটুরী, তারাটি, রওয়ারচর, গৌরীপাড়া, কাঁঠালিয়া, কমলাপুর, চন্দনিআটা, কান্দিগাঁও অঞ্চলে ৩ সহস্রাধিক কোচ পরিবার বসবাস করেন।
অর্থনৈতিক অবস্থা
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং ধূমকেতু ডটকমকে জানান, অনেক আগেই ভেঙে পড়েছে কোচ জাতিগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক অবস্থা। কৃষিকাজ তাদের প্রধান জীবিকা। ভূ-সম্পত্তি না থাকার কারণে তাদের অধিকাংশ পরিবারই প্রান্তিক চাষীতে পরিণত হয়েছে। শিক্ষায় পিছিয়ে থাকায় সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কোচ সদস্য/সদস্যার সংখ্যা হাতেগোনা। তাদের মূল পেশা কৃষিকাজ হলেও পরিবারের সদস্য বেড়ে যাওয়া, জমি হারানো এবং স্থায়ী কর্মসংস্থানের অভাবে অনেকেই হয়ে গেছে দিনমজুর। কেউ কেউ শহরমুখী হয়ে নানা পেশায়যুক্ত হয়েছে। এছাড়া বেকার হয়ে ঘরে বসে থেকে মানবেতর জীবন-যাপন করছে এমন সংখ্যাও কম না।
শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ী উপজেলার খলচাঁন্দা গ্রামের বাসিন্দা দিনমুজর অনিল কোচ ধূমকেতু ডটকমকে জানান, আমাদের গ্রামে স্বাধীনতার পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত সরকারি চাকুরি পাওয়া লোকের সংখ্যা ৩ জনও হবে না। ৮৫ বছর বয়সের রুক্কিনী কোচ জানান, আমার বাবার বাড়ি পাশ্ববর্তী সমেশ্চুরা গ্রামে। দেশ স্বাধীনের আগে বৌ আসার সময় পুরো এলাকা ছিল পাহাড়-জঙ্গলে ঘেরা। ফলমূল, পশু-পাখি ও কাঠের অভাব ছিল না। এখন কিছুই নেই। জঙ্গল না থাকায় বন্ধ হয়ে গেছে উপার্জনের পথ। জমি হারিয়ে অনেকে হয়েছে দিনমজুর। একই গ্রামের দুর্জয় কোচ গ্রামের চেল্লাখালী নদী দেখিয়ে জানান, নদীতে আমরা অনেক মাছ ধরেছি, নদীতে সবসময় জল থাকতো, বর্ষায় ভারত থেকে অনেক গাছ-কাঠ ভেসে আসতো। কাঠগুলো নদী থেকে কুঁড়িয়ে বাজারে বিক্রি করতাম। নদী শুকিয়ে যাওয়ায় মাছও নেই, কাঠও পাওয়া যায় না।
৮০ বছর বয়সের পানমনি কোচ জানান, আমাদের পাহাড়-বন ধ্বংস হয়ে গেছে। তাই আগের মতো রোজগার নাই। এর মধ্যে ভারত থেকে হাতি ঢুকে আমাদের ঘর-বাড়ি ভেঙ্গে ফেলে, নষ্ট করে ফসল।
ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে বসবাসরত কোচ জাতিগোষ্ঠীর সংখ্যা হবে তিন সহস্রাধিক। তাদের শিক্ষা ও আর্থিক অবস্থা অত্যন্ত করুণ। কোচ পরিবারের অধিকাংশই বাঁশের সামগ্রী তৈরি কিংবা দিনমজুরী করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। বাঁশ সংকট, মূল্যবৃদ্ধি এবং বাঁশের তৈরি সামগ্রীর চাহিদা কমে যাওয়ায় এ শিল্পেও চলছে সংকট। রওয়ারচর গ্রামে কোচদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে দেখা যায়, কুড়েঘরে বসবাসকারী কোচদের নেই কোনও টিউবওয়েল। অনেক দূর থেকে পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে তাদের।
সমাজ ব্যবস্থা :
শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতী উপজেলার বাঁকাকুড়া গ্রামের আদিবাসী নেতা ধীমান চন্দ্র কোচ ধূমকেতু ডটকমকে জানান, কোচ সমাজ মূলত পিতৃপ্রধান এবং আট দলে বিভক্ত। দলগুলি আবার ‘ভাগ’ বলে পরিচিতি। প্রত্যেক ভাগের রয়েছে অনেক গোত্র। কোচরা গোত্রকে নিকিনি বলে। পিতৃপ্রধান হলেও পরিবারের সন্তান-সন্তুতি মায়ের গোত্রনাম গ্রহণ করে। পুত্র সন্তানেরাই পারিবারিক সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়। নিজ গোত্রের মধ্যে বিবাহ নিষিদ্ধ। যৌথ পরিবারের তুলনায় বর্তমানে একক পরিবারের সংখ্যাই বেশি। কোচরা সাধারণত যে কোনো সমস্যা সামাজিকভাবে নিরসন করে। কোচ মেয়েরা বিয়ের পর স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য স্বামীগৃহে চলে যায়। কোচ মহিলারা সিঁথিতে সিঁদুর পরে এবং হাতে চুড়ির সঙ্গে শাঁখা ব্যবহার করে। তাদের সমাজে একবিবাহ প্রথাই প্রচলিত। তবে কোনো কোনো পুরুষকে একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করতেও দেখা যায়।
খাদ্য ও পোশাক:
ধীমান চন্দ্র কোচ জানান, বাঙালী খাবারে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে কোচ সম্প্রদায়। তাদের অনেকেই আমিষভোজী। তারা গোমাংস খায় না। শূকর, খরগোশ, সজারু,কচ্ছপ, কুচিয়া প্রভৃতির মাংস তাদের নিকট প্রিয়। তেল ছাড়াও তারা তরকারিতে ক্ষার বা সোডা ব্যবহার করে। চালের গুঁড়া এবং সোডা সহযোগে রান্না করা শূকরের মাংস তাদের খুব মজার তরকারি। বিভিন্ন পালাপার্বণে তারা চালের পিঠা তৈরি করে। তারা মদ্যপান করে, তবে যারা গুরুর কাছে দীক্ষামন্ত্র গ্রহণ করেছে তারা মদ, মাংস পরিহার করে চলে। দুধ এবং দুগ্ধজাত খাদ্যসামগ্রীর প্রতি তাদের বাড়তি আগ্রহ রয়েছে। নানা উৎসব কিংবা বিয়ের অনুষ্ঠানে মাছ মাংসের পাশাপাশি তারা ক্ষীর, পায়েস, দই, মিষ্টি প্রভৃতি পরিবেশন করে।
কোচ পুরুষেরা ধুতি, লুঙ্গি, জামা, গেঞ্জি প্রভৃতি ব্যবহার করে। মহিলাদের নিজস্ব ঐতিহ্যবাহী পোশাক রয়েছে যা তারা ঘরোয়া পরিবেশে ব্যবহার করে। এ পোশাককে লেফেন বলা হয়। কোচ মহিলারা জামা অথবা গেঞ্জির সঙ্গে লেফেন ব্যবহার করে।
ভাষা ও ধর্ম :
আদিবাসী নেতা বিনয় কোচ ধূমকেতু ডটকমকে বলেন, কোচদের রয়েছে নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি। তবে তাদের ভাষার নিজস্ব বর্ণমালা নেই। ছেলেমেয়েরা বাংলা ভাষার মাধ্যমে শিক্ষাগ্রহণ করে। ধর্মের বিষয়ে বিনয় কোচ বলেন, কোচ সম্প্রদায় মূলত হিন্দু ধর্মাবলম্বী। তারা যেমন দুর্গাপূজা, কালীপূজা, সরস্বতীপূজা, লক্ষ্মীপূজা সম্পন্ন করে তেমনি আদি ধর্মের দেব-দেবীরও পূজা করে।
উৎসব:
শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতী উপজেলার গুরুচরণ-দুধনই আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক যুগল কিশোর কোচ বলেন, কোচদের রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি। আর সংস্কৃতিভিত্তিক বেশ কিছু উৎসব পালন করে কোচ সম্প্রদায়। পহেলা বৈশাখে তারা নববর্ষ বা বিহু পালন করে থাকেন। তখন বাড়িতে বাড়িতে বিহু উৎসব পালনের জন্য চালের গুড়া, শুটকি শুকানো, ঘরদোর পরিষ্কার করাসহ নানা প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়। তবে একসময় আয়োজন করে কোচ পল্লীগুলোতে বিহু বা নববর্ষ উৎসব পালিত হতো। এ উপলক্ষে “কচ কাহিনী”, “দেবী যুদ্ধ”, “থুবল মাগাইনি”, “লেওটানা” ও পালাগানের আসর বসতো। বাড়ি বাড়ি ঘুরে কালো, মৃদঙ্গ, ঢোল, গঙ্গ, করতাল ও বাঁশির বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে নাচ আর গান হতো। রাতে খাবার পর পরিবারের সবাই মিলে পাটি বিছিয়ে জমতো “ফেলাওনি” বা আড্ডা। কিন্তু কালের বিবর্তনে এসব আর দেখা যায় না।
যুগল কিশোর কোচ আরও জানান, এখন বাড়ি বাড়ি বিহু’র আচারাদি হয়, কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে আয়োজন করে বিহু করা হয় না। এজন্য খরচ অনেক, পরিশ্রমও অনেক। তবে যদি সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা থাকতো, তাহলে হয়তোবা এটা আনুষ্ঠানিকভাবে করা যেতো। এতে ঐতিহ্য টিকে থাকতো। অন্যরাও কোচদের জীবনাচার, লৌকিকতা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে পারতো, যোগ করেন তিনি।
কোচ নেতা মুক্তিযোদ্ধা নবীন কোচ বলেন, বিহুর দিনে সকল কোচ বাড়িতেই ঐতিহ্যবাহী কাঁথামুড়ি পিঠা, মেরা, তেলের পিঠাসহ নানা ধরনের পিঠা তৈরি হয়। সাথে থাকে মেরা (পানীয়)। অতিথিদের আমরা পিঠা ও মেরা দিয়ে আপ্যায়ন করে থাকি। এদিন সবাই নতুন জামাকাপড় পরবেন। ভালো কাজ করবেন। কোনো ধরনের ভারী কাজ করবেন না। বাড়ির বাইরে দূরে কোথাও যাবেন না। একেবারে বাধ্য না হলে কোনো ধরনের যানবাহনে চড়বেন না। কোচ নারীরা তাদের ঐহিত্যবাহী পোষাক নতুন “লেফেন” পরবেন। নতুন জামা-কাপড় পরে কোচ পুরুষ-নারীরা নিকটাত্মীয়দের বাড়িতে বেড়াতে যাবেন। আনন্দ-উৎসব করে “কাঁথামুড়ি” পিঠাসহ অন্যান্য পিঠা খাবেন এবং মেরা পান করবেন। এভাবেই সারাদিন কাটাবেন।
রাংটিয়া গ্রামের হারেজ চন্দ্র কোচের স্ত্রী সুরবালি কোচ বলেন, আমরা বিশ্বাস করি বছরের প্রথম দিনটি যদি ভালোভাবে কাটে, তাহলে সারাবছর ভালো যাবে। এজন্য নববর্ষ বা বিহুর দিন পূজাপালির বাইরে আনন্দ করে কাটাতে চেষ্টা করি। প্রতিবার বিহুর সময় বাবার বাড়ি যাই। ওইদিন গাড়িতে না চড়ে হেঁটেই যাওয়া-আসা করি।
ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় মহাসচিব স্বর্ণকান্ত হাজং ধূমকেতু ডটকমকে জানান, নানা প্রতিকূল অবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে করতে দেশের কোচ সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব আজ চরম সংকটে পড়েছে। তাদের অনেকেই ভারতে চলে গেছে। সরকারি ও বেসরকারি সহযোগিতা না পেলে তাদের জীবন আরো বিপন্ন হবে।