ডেস্ক নিউজ, সুখবর ডটকম: বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত মায়ানমারের কোকো দ্বীপ দীর্ঘদিন ধরে দক্ষিণ এশিয়ার বিশ্লেষক, সাংবাদিক ও নীতি নির্ধারকদের ভূ-রাজনৈতিক চক্রান্ত ও বিতর্কের বিষয়।
১৯৯০ দশকের শুরু থেকেই মায়ানমার এই দ্বীপে চীনা গোয়েন্দাদের প্রবেশাধিকার প্রদান করেছে বলে অভিযোগ উঠে, যদিও এ বিষয়ে যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় নি। তবে সম্প্রতি স্যাটেলাইট ছবির মাধ্যমে দ্বীপের কিছু কার্যকলাপ প্রকাশিত হয়, যা বিশেষ করে ভারতকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।
সামরিক আধুনিকীকরণের মাধ্যমে দ্বীপটি বিমান চলাচলের ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা অর্জনের চেষ্টা করছে। দ্বীপে চীনা গোয়েন্দার উপস্থিতি রয়েছে এমন ধারণার মধ্যেই সাম্প্রতিক স্যাটেলাইট হতে প্রাপ্ত ছবিগুলো প্রকাশ করছে যে ভারতের আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ থেকে মাত্র ৫৫ কিলোমিটার উত্তরের এই কোকো দ্বীপ থেকে মায়ানমার সামুদ্রিক নজরদারি অভিযান চালাতে পারে।
স্যাটেলাইট ছবি তোলার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে দক্ষ, ম্যাক্সার টেকনোলজিস চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে কিছু ছবি প্রকাশ করে যা কোকো দ্বীপের আমূল পরিবর্তন তুলে ধরে।
গত দুই বছরের গৃহযুদ্ধের কারণে তাতমাদও নামের সামরিক জান্তা ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং মায়ানমারও আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। চীনের পূর্ব উপকূলে জাহাজ চলাচলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রপথ এবং চীনের ইউনান প্রদেশে আমদানির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হলো মালাক্কা প্রণালী। এই মালাক্কা প্রণালীর সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করার জন্য চীন ভারত মহাসাগরের সমুদ্রপথে প্রবেশ করার উদ্দেশ্যে চীন-মায়ানমার করিডোরের মাধ্যমে দেশটিতে অনেক বড় বিনিয়োগ করেছে।
কোকো দ্বীপের রানওয়ের প্রাথমিক দৈর্ঘ্য ছিল ১৩০০ মিটার। তবে গত দশকে এটিকে ২৩০০ মিটার পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছে।
ধারণা করা হচ্ছে মায়ানমারের সামরিক অভ্যুত্থান দেশটিতে চীনা প্রভাবের বৃদ্ধি ঘটিয়েছে। মায়ানমারের সশস্ত্র বাহিনি একদিকে দেশের বিশাল অংশ দখল করতে সংগ্রাম চালাচ্ছে, অন্যদিকে চীন দেশটিতে বিশাল বিনিয়োগ করছে।
দক্ষিণ এশিয়া এবং ভারত মহাসাগর অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে মোকাবেলা করতে তৎপর ভারত। তবে কোকো দ্বীপের উন্নয়ন ঘটিয়ে চীনের সাহায্যে মায়ানমার একটি নতুন বিমানঘাঁটি নির্মাণ করছে, যা ভারতের জন্য একটি নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসছে।
তাতমাদো দ্বারা কোকো দ্বীপের সামরিকীকরণ, ভারত এবং এর নৌবাহিনীর জন্য নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে।
ভারতের প্রভাবকে কমিয়ে শীঘ্রই চীন মায়ানমারে তাদের বাণিজ্যিক সুবিধার জন্য অন্য পন্থা অবলম্বন করতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ইতিমধ্যেই কোকো দ্বীপে বিমানঘাঁটির নির্মাণ এ ধারণাকে সত্য প্রমাণিত করতে চলেছে।
তবে এখানে চিন্তার আরেকটি বিষয় রয়েছে। অর্থনৈতিক বিনিয়োগের প্রলোভন দেখিয়ে কোকোর বিমানঘাঁটি থেকে অর্জিত নৌ সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে চীন যদি তাতমাদোর উপর আরো চাপ প্রয়োগ করে, তাহলে হয়তো এটি ভারতকে উপেক্ষা করে চীনকে গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক সুবিধা প্রদান করবে।
ভারতীয় নৌবাহিনীর উপর নজরদারির জন্য চীন মায়ানমারকে ব্যবহার করবে, বিশেষ করে কোকো দ্বীপের মাধ্যমে এ ধারণা অবশ্য নতুন নয়। কোকো দ্বীপের ইতিহাসজুড়ে ষড়যন্ত্র বিদ্যমান। মায়ানমারের সামরিক বাহিনিকে শক্তিশালী করার পেছনে চীনের হাত রয়েছে বলে বরাবরই ধারণা করা হচ্ছিল।
১৯৯০ এর দশকে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে চীনা সামরিক বাহিনি কোকো দ্বীপে ৪৫-৫০ মিটারের এন্টেনা স্থাপন করেছে। মূলত ১৯৮৮ সালে ইয়াঙ্গুনে গণতন্ত্রপন্থী বিক্ষোভের বিরুদ্ধে আন্দোলনের পর মায়ানমার এবং চীনের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে উঠে।
বর্তমানেও দেখা যাচ্ছে যে, মায়ানমার যখন আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে, তখনও দেশটি কাঁচামালের বিনিময়ে চীনের জন্য সামরিক সরঞ্জামের প্রধান রপ্তানি কেন্দ্র হয়ে উঠেছে।
ভারতীয় কর্মকর্তারা মানাউং দ্বীপ, হ্যাংগি দ্বীপ, জার দার গি দ্বীপ এবং কোকো দ্বীপে চীনা রাডার ঘাঁটির উল্লেখ করেন। মায়ানমারের দ্বীপপুঞ্জে চীনের উপস্থিতির মুখরোচক গল্প এক দশকেরও বেশি সময় ধরে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রচারিত হয়ে আসছে।
২০০৫ সালে, ভারতের নৌবাহিনীর প্রধান এডমিরাল অরুণ প্রকাশ কোকো দ্বীপে চীনা সামরিক স্থাপনার অনুপস্থিতি সম্পর্কে জানান। একইবছর, মায়ানমারের জান্তা সরকার ভারতীয় প্রতিরক্ষা কর্মকর্তাদের কোকো দ্বীপ পরিদর্শনের আহ্বান জানান। সেসময় দ্বীপে বিমানপথের উপস্থিতি নিশ্চিত করা হলেও কোন ধরনের চীনা সামরিক উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া যায় নি।
ভারত মহাসাগরের উপর কোকো দ্বীপের প্রভাব বৃদ্ধি করতে দ্বীপটিকে উন্নত করা হচ্ছে। ম্যাক্সারের প্রকাশিত ছবিগুলো এটাই প্রমাণ করে যে দ্বীপটিতে ব্যাপক পরিবর্তন দৃশ্যমান।
এমএইচডি/ আই. কে. জে/
আরো পড়ুন: