অভিমত

কিংবদন্তী তারুণ্যের প্রতীক শহীদ শেখ কামাল

তাপস হালদার:
৫ আগস্ট ১৯৪৯ সাল, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের দ্বিতীয় সন্তান হয়ে ঘর আলোকিত করে গোপালগঞ্জের মধুমতি নদীর তীরবর্তী টুঙ্গীপাড়ায় জন্মেছিলেন কিংবদন্তী তারুণ্যের প্রতীক শহীদ শেখ কামাল। তুরস্কের জাতির পিতা মহামতি মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের নামানুসারে পিতা বঙ্গবন্ধু প্রথম পুত্রের নাম রেখেছিলেন শেখ কামাল। ছোট্ট কামাল শিশুকালে পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত ছিল। শেখ কামালের জন্মের পরপরই ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে পিতা মুজিব দীর্ঘদিন কারাগারে ছিলেন। ’৫২ সালে কারাগার থেকে বের হওয়ার পর ছেলে কামাল সম্পর্কে একটি হৃদয়স্পর্শী বর্ণনা পিতা বঙ্গবন্ধু তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইতে লিখেছেন, “একদিন সকালে আমি আর রেনু বিছানায় বসে গল্প করছিলাম। হাচু ও কামাল নিচে খেলছিল।হাচু মাঝে মাঝে খেলা ফেলে আমার কাছে আসে আর আব্বা আব্বা বলে ডাকে। কামাল চেয়ে থাকে। এক সময় কামাল হাসিনাকে বলছে, ‘হাচু আপা, হাচু আপা, তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা বলে ডাকি? আমি আর রেনু দু’জনেই শুনলাম। আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠে যেয়ে ওকে কোলে নিয়ে বললাম আমি তো তোমারও আব্বা। কামাল আমার কাছে আসতে চাইত না। আজ গলা ধরে পড়ে রইল। বুঝতে পারলাম এখন আর ও সহ্য করতে পারছে না। নিজের ছেলেও অনেকদিন না দেখলে ভুলে যায়”।

শেখ কামাল ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। খেলাধুলা, গান, নাটক, শিল্প সাহিত্য, রাজনীতি প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাঁর ছিল দীপ্ত পদচারণা। ছোটবেলা থেকেই সব ধরণের খেলায় প্রচন্ড আগ্রহ ছিল। শাহীন স্কুলে পড়ার সময় স্কুলের প্রতিটি খেলায় অপরিহার্য অংশ ছিলেন। তবে ক্রিকেটাই বেশি টানত তাঁকে। ছিলেন সে সময়ের দ্রুত গতির একজন ফাস্ট বোলার। নিখুঁত লাইন লেন্থ প্রচন্ড গতি দিয়ে প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানকে কাবু করতেন তিনি। অবিভক্ত পাকিস্তানের উদীয়মান পেসার হওয়া সত্ত্বেও শুধুমাত্র শেখ মুজিবের ছেলে হওয়ার কারণে কখনো জাতীয় দলে খেলার সুযোগ পাননি। আজাদ বয়েস ক্লাবের হয়ে দীর্ঘদিন প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লীগ খেলেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে সল্লিমুল্লাহ হলের বাস্কেটবল দলের অধিনায়ক ছিলেন। তিনি যতদিন খেলেছেন ততদিন আন্তঃহল প্রতিযোগিতায় সলিমুল্লাহ হল শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রেখেছে।

১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে খেলাধুলার উন্নয়নের জন্য আবাহনী সমাজকল্যাণ সংস্থা গঠন করে ইকবাল স্পোর্টিং ফুটবল ক্লাব এবং ক্রিকেট ও হকির জন্য ইস্পাহানী স্পোর্টিং ক্লাব কিনে সব ক্লাবগুলোকে একত্রিত করে ‘আবহানী ক্রীড়া চক্র’ নামে ক্লাব তৈরি করে নতুন দিগন্তের সূচনা করেন।

ক্রিকেট, ফুটবল ও হকিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাওযার স্বপ্ন দেখতেন শেখ কামাল। স্বপ্ন দেখতেন ক্রীড়া ক্ষেত্রে একদিন বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক পরাশক্তি হবে। ১৯৭৩ সালে আবহানীর জন্য বিদেশী বিল হার্টকে ফুটবল কোচ এনে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। তখনকার সময়ে উপমহাদেশে কোনো জাতীয় দলেও বিদেশী কোচের কথা ভাবতেই পারত না। শেখ কামাল যদি সুযোগ পেতেন তাহলে হয়ত ক্রিকেটে আরো অনেক আগেই আমরা টেস্ট স্ট্যাটাস পেতাম, ক্রিকেটে বাংলাদেশ আজ পরাশক্তিতে পরিণত হত। ফুটবল, হকিতেও আন্তজার্তিক সুনাম বয়ে আনতে পারত।

বঙ্গবন্ধু বড় ছেলে শেখ কামালকে ছোট বয়সেই ছায়ানটে ভর্তি করেছিলেন। গানের প্রতিভাও এমন ছিল যে শুধু গান গাইলেও বড় তারকা হতে পারতেন। ১৯৬৯ সালে সামরিক জান্তা রবীন্দ্র সঙ্গীতকে নিষিদ্ধ করলে, গর্জে উঠেছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালির সুযোগ্য সন্তান শেখ কামাল। অহিংস প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে রবীন্দ্র সংগীত গেয়েই তিনি সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতেন।

ছায়ানটের সেতার বাদক বিভাগের ছাত্র শেখ কামাল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ঢাকা থিয়েটার। পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে সেতার বাজানো প্রতিযোগিতায়ও তিনি দ্বিতীয় হয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্য অঙ্গনে সুঅভিনেতা হিসেবে ব্যাপক সুখ্যাতি ছিল। কলকাতার স্টেজেও প্রতিনিধিদল নিয়ে মুনীর চৌধুরীর বিখ্যাত ‘কবর’ নাটক মঞ্চায়ন করেন। প্রধান চরিত্রে তিনিই অভিনয় করেন।‘স্পন্দন’ নামে স্বাধীন বাংলাদেশে তিনিই প্রথম ব্যান্ড দল গঠন করেছিলেন।

রাজনীতির মাঠেও ছিল সমান পাদচারণা। ছাত্রলীগের একনিষ্ঠ কর্মী ও সংগঠক ছিলেন। ঢাকা কলেজের ছাত্র থাকা অবস্থায় ৬দফা, ১১দফা আন্দোলনসহ ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানেও রাজপথে কলেজের ছাত্রদের নিয়ে আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও কখনও পদের প্রতি মোহ ছিলনা। বরং অন্যদেরকে সামনে এগিয়ে দিতেন, সেটাতেই তিনি বেশি আনন্দ পেতেন। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য পদ নিয়েই খুশি ছিলেন।

২৫ মার্চের মধ্যরাতে বঙ্গবন্ধু গ্রেফতারের পরই ছোট ভাই শেখ জামালকে নিয়ে দেশকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। বন্ধু রাষ্ট্র ভারত থেকে ট্রেনিং নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল আতাউল গনি ওসমানীর এডিসি হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭১ সালের ৯ অক্টোবর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৬১ জন কমিশনপ্রাপ্ত অফিসারদের মধ্যে একজন ছিলেন শেখ কামাল।

স্বাধীনতার পর সেনাবাহিনীর পদ ত্যাগ করে অসমাপ্ত শিক্ষা জীবন সম্পন্ন করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেন। সমাজ বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তরে ভর্তি হন। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের অধিকার আদায়ের জন্য তৈরি করেন ‘শিক্ষা সংস্কার আন্দোলন’ নামে একটি সংগঠন। এ সংগঠনের কাজ হল সদ্য স্বাধীন দেশে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের শিক্ষার ক্ষেত্রে যে অপ্রতুলতা রয়েছে সেগুলো তুলে ধরা। প্রতিটি বিভাগের মেধাবী শীর্ষ তিন জন ছাত্র/ছাত্রীকে কমিটির সদস্য করা হয়।

১৯৭৫ সালের ১৪ জুলাই শহীদ হওয়ার মাত্র এক মাস আগে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বিবাহের ক্ষেত্রেও তিনি খেলার জগৎকে বেছে নিয়েছিলেন। শেখ কামালের নবপরিণীতা বধূ সুলতানা খুকু ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ব্লু খ্যাতি প্রাপ্ত ক্রীড়াবিদ। তিনি ১৯৭৩ সালে ভারতের নয়াদিল্লীতে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত গ্রামীণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় লংজাম্প ইভেন্টে অংশ নিয়ে দ্বিতীয় হন। এটাই ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক পদক।

মহান মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শত্রুরা বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদেরকে টার্গেট করে মিথ্যা প্রোপাগান্ডা, কুৎসিত অপপ্রচার চালিয়েছে। মেধাবী প্রতিভাবান শেখ কামাল ছিলেন তাদের প্রধান টার্গেট। আজ ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সেগুলো সবই মিথ্যা ছিল। মিথ্যা দিয়ে সত্যকে আড়াল করা যায় না, সত্যের জয় অবশ্যম্ভাবী।

মাত্র ২৬ বছরের একজন তরুণ কী করেননি? তারুণ্যের দীপ্ত প্রতীক ও বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী শেখ কামালের সব ক্ষেত্রেই ছিল দীপ্ত পদচারণা। তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আবদুল মতিন চৌধুরী সেজন্যই তাঁকে ডাকতেন অলরাউন্ডার বলে। অসম্ভব মেধাবী সৃজনশীল মানুষটাকে আমরা তরুণ প্রজন্মের কাছে সেভাবে তুলে ধরতে পারিনি, এটা আমাদের ব্যর্থতা।

সম্প্রীতি বাংলাদেশের আহ্ববায়ক, সর্বজন শ্রদ্ধেয় সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় বিগত কয়েক বছর ধরে ৫ই আগস্ট শহীদ শেখ কামালের জন্মদিন উপলক্ষে তাঁর বন্ধুদের নিয়ে স্মৃতিচারণমূলক আলোচনা সভার আয়োজন করে থাকেন। তিনি নিজেও ছিলেন শেখ কামালের একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আলোচনা সভায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে শেখ কামালের যাঁরা বন্ধু ছিলেন তাঁরাই শুধুমাত্র স্মৃতিচারণ করে থাকেন। গত বছরের অনুষ্ঠানটিতে আমার যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। শেখ কামালের প্রিয় বন্ধুদের আলোচনা শুনে বার বার একটি কথা মনে হয়েছে, যদি আমাদের তরুণ সমাজ শেখ কামালের আদর্শকে জানার সুযোগ পেত, তাহলে সমাজ হত আরো গতিশীল, জীবন হত শৈল্পিক। সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ রাষ্ট্র হত।

শেখ কামালের স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন তাঁর ছোট বেলার খেলার সাথী, প্রিয় আপা, আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

তরুণ প্রজন্মের মধ্যে শেখ কামালের আদর্শকে ছড়িয়ে দিতে হবে। শেখ কামালকে জানার সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। আমাদের তরুণরা অনেক বিদেশীকে আইডল মানে। অথচ মাত্র ২৬ বছরের একজন তরুণ আমাদের জন্য যা করে গেছেন, তা নিঃসন্দেহে অনুকরণীয়, অনুস্মরণীয়। শহীদ শেখ কামালই হতে পারেন আমাদের তরুণ সমাজের আইডল। শুভ জন্মদিনে শহীদ শেখ কামালের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই।

লেখক: সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ ও সাবেক ছাত্রনেতা।

ইমেইল: haldertapas80@gmail.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *