নবনীতা দত্ত তিথি :

“চিন্তা করিও না। জীবনে বহু ঈদ এই কারাগারে আমাকে কাটাতে হয়েছে, আরও কত কাটাতে হয় ঠিক কি! তবে কোনো আঘাতেই আমাকে বাঁকাতে পারবে না। খোদা সহায় আছে।”

হাজার বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি; অন্যায়, অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো জীবনভর আপোসহীন নেতা ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি জনগণের ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্যে ছিলেন হিমালয়ের মতোই অবিচল। তাই হয়তো ফিদেল কাস্ত্রো উনার সম্পর্কে বলেছিলেন,

” আমি হিমালয় দেখিনি, বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি।”

বঙ্গবন্ধু তাঁর ৫৫ বছরের স্বল্প জীবনের ৪,৬৮২ দিনই কাটিয়েছেন তৎকালীন পাকিস্তানের বিভিন্ন কারাগারে। কারাগারে থাকাকালীন তাঁর লেখা পাণ্ডুলিপিটি পরবর্তীতে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয় “কারাগারের রোজনামচা” নামে।

“রোজনামচা” এর প্রচলিত ইংরেজি শব্দ “ডায়েরি”। প্রতিদিনকার ঘটে যাওয়া নানা ঘটন-অঘটন সম্পর্কে লিখে রাখা পাণ্ডুলিপিকে বলে রোজনামচা।

“কারাগারের রোজনামচা” গ্রন্থে ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৮ সালের বিভিন্ন ঘটনা, রাজনৈতিক সংকট, ছয় দফা আন্দোলন, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের তৎকালীন অবস্থাসহ বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে জানা যায়। রোজনামচার প্রথমেই দেখা যায় বঙ্গবন্ধু এর নাম রেখেছিলেন,

“থালাবাটি কম্বল, জেলখানার সম্বল।”

বইয়ের শুরুতেই তিনি পূর্ব পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় কারাগার এবং কারাজীবনের বর্ণনা দিয়েছেন। বাইরে থেকে দেখে আমরা কখনোই বুঝতে পারব না কারাগারের অভ্যন্তরীণ জীবনযাপন সম্পর্কে। কারাগার মূলত একটি আলাদা দুনিয়া।

শেখ মুজিবুর রহমানের মতে, কারাগার কখনোই কোনো অপরাধীকে শোধরায় না। বরং কোনো ছিঁচকে চোর কারাগারে এসে বড় বড় চোর-ডাকাতের পাল্লায় পড়ে দাগী আসামীতে পরিণত হয়। কারাজীবনের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড, ত্রুটিবিচ্যুতি, জেলের কর্মচারীদের বিভিন্ন নৃশংসতা কিংবা মহানুভবতা সবকিছুই স্থান পেয়েছে এ রোজনামচায়।

ভাষা আন্দোলন-পরবর্তী এবং ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের পূর্ববর্তী সময়কার একটি সমৃদ্ধ দলিল এ রোজনামচা। পাকিস্তানি শাসকবর্গ তাদের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিদের দমিয়ে রাখতে তাদের রাজবন্দী হিসেবে কারাগারে আটকে রেখে তাদের উপর চালাতো অমানুষিক নির্যাতন। রাজবন্দীদের সাধারণ কয়েদিদের সাথে রাখা হতো না। বরং তাদের জন্যে ছিল আলাদা ছোট ছোট সেল।

তৎকালীন সময়ে স্বাধীনতা বলতে মানুষের কিছুই ছিল না। দেশজুড়ে ছিল সামরিক শাসনের ভয়াবহতা এবং নৃশংসতা। মানুষের রাজনৈতিক অধিকার ছিল মিলিটারির বন্দুকের নলে বন্দি। সংবাদপত্রে ছাপানো যেতো না বস্তুনিষ্ঠ সত্যতা। সত্য কথা বলতে গেলেই, নিজের অধিকার চাইতে গেলেই সংবাদপত্রের সম্পাদককে যেতে হতো জেলে।

১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ছয় দফা দাবি পেশ করলে আইয়ুব সরকার ভীত হয়ে তাদেরকে দমিয়ে রাখতে “দেশরক্ষা আইন” এর মাধ্যমে বন্দি করে শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ছাত্রনেতা নূরে আলম সিদ্দিকীসহ অনেককে। পারতপক্ষে এটা কোনো দেশরক্ষা আইন ছিল না, বরং ছিল আইয়ুব সরকার রক্ষা আইন।

“কারাগারের রোজনামচা”য় বঙ্গবন্ধু তাঁর নিজ জীবনের কাহিনি লিপিবদ্ধ করলেও প্রকৃতপক্ষে এটি হয়ে উঠেছে তৎকালীন বাংলার ইতিহাসের এক সমৃদ্ধ দলিল, যা পড়ার মাধ্যমে আমরা জানতে পারি দেশের ঐ সময়কার সরকারব্যবস্থা, রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে, কারাগার জীবন সম্পর্কে এবং কারাবন্দিদের জীবন সম্পর্কে।

“কারাগারের রোজনামচা” গ্রন্থের নামকরণ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্যা কন্যা শেখ রেহানা। এ গ্রন্থটি এখন পর্যন্ত ৩টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। সর্বশেষ নেপালী ভাষায় অনূদিত হয়েছে।

লেখা শেষ করব গ্রন্থটির এক গুরুত্বপূর্ণ চরণের মধ্য দিয়ে, যেখানে প্রকাশ পেয়েছে শেখ মুজিবুর রহমানের দেশ মাতৃকার প্রতি অসীম ভালোবাসা। একজন মানুষ দেশের জন্য ঠিক কতোটা ত্যাগ স্বীকার করতে পারেন তা হয়তো বঙ্গবন্ধুকে না দেখলে আমরা উপলব্ধিও করতে পারতাম না।

দেশের প্রতি সীমাহীন ভালোবাসা থেকেই তিনি বলেছিলেন,

“তোমাকে আমি ভালোবাসি। মৃত্যুর পর তোমার মাটিতে যেন আমার একটু স্থান হয়, মা।”

আরো পড়ুন:

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে খোকন কুমার রায়ের হৃদয়স্পর্শী গান “হৃদয়ে বঙ্গবন্ধু”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *