অভিমত

কাবুল থেকে কাশ্মীর এবং অতঃপর

মেজর জেনারেল মোহাম্মাদ আলী শিকদার (অব:) :

করোনা মহামারীকে ছাড়িয়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় হট ইস্যু এখন আফগানিস্তান। মধ্যযুগীয় বর্বর মতাদর্শে দীক্ষিত তালেবান বাহিনী অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে ইতিমধ্যেই রাজধানী কাবুল দখল করেছে। এর আগে ৩৪টির মধ্যে বেশিরভাগ প্রাদেশিক রাজধানী তালেবান বাহিনী দখল করে নেয়। প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি গত রবিবারই ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে বিদেশের মাটিতে আশ্রয় নিয়েছেন। আশরাফ গনি সরকারের জাতীয় সেনাবাহিনী অস্ত্র ফেলে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যাচ্ছে, আর নয়তো হাত উঁচু করে তালেবান বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করছে- এ দৃশ্য দেখেছে বিশ্ববাসী।

২০২০ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবান বাহিনীর মধ্যে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরের পরপরই একটা বাংলা দৈনিকে আমি লিখেছিলাম এই চুক্তির কোনো মূল্য থাকবে না, বরং সুযোগ মতো তালেবান এই চুক্তিকে ছুঁড়ে ফেলে দেবে, যেমনটি উত্তর ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট লি ডাক যো আমেরিকার সঙ্গে স্বাক্ষরিত ১৯৭৩ সালের প্যারিস শান্তি চুক্তিকে এক বছরের মাথায় ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন ।

আমেরিকার সঙ্গে চুক্তিতে তালেবানরা যে সব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তার একটি প্রতিশ্রুতিও বিশ্বাস করার মতো ভিত্তি ছিল না। অন্যতম প্রতিশ্রুতি ছিল তারা আল-কায়েদা, আইএস এবং অন্যান্য চিহ্নিত সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিবে না এবং তাদের সঙ্গে কোনো সংযোগও রাখবে না। এরকম একটা ডাহা ভণ্ডামিপূর্ণ প্রতিশ্রুতি আমেরিকান বিশেষজ্ঞগণ কিভাবে বিশ্বাস করলেন বুঝতে পারছি না।

আল-কায়েদা ও আইএস যোদ্ধাগণ গত ২০ বছর তালেবানের সঙ্গে সমান্তরালভাবে আফগান জাতীয় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। কিন্তু একটিবারের জন্যেও এমন হয়নি যে, তালেবান যোদ্ধাদের সঙ্গে আইএস বা আল-কায়েদা যোদ্ধাদের সংঘর্ষ বেঁধেছে।

পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই, তালেবান এবং অন্যান্য জঙ্গি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর ঐক্যবদ্ধতার একটা উদাহরণ দিই। পেশোয়ারের নিকট গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডের পাশে দারুল উলুম হাক্কানিয়া নামে বিশাল এক মাদ্রাসা আছে। উগ্রপন্থী মোল্লারা এটাকে নাম দিয়েছে ইউনিভার্সিটি অফ জিহাদি। এখানে শুধু পাকিস্তান ও আফগানিস্তান নয়, সারা বিশ্বের উগ্রপন্থা ওহাবীবাদে বিশ্বাসী হাজার হাজার ছাত্র এক সঙ্গে উগ্রবাদী ইসলামী শিক্ষা শুধু নয়, সশস্ত্র জিহাদের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। এই দারুল উলুম জিহাদি ইউনিভার্সিটিতে ২০০১ সালের ৯ জানুয়ারি বিশাল এক আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তখনকার তালেবান সরকারের অর্ধডজন মন্ত্রীসহ ৩০টি দেশ থেকে প্রায় ৩০০ উগ্রবাদী ইসলামিস্ট নেতা উক্ত সম্মেলনে যোগ দেন। সম্মেলনের উদ্দেশ্য ছিল আল-কায়েদা – তালেবান সংহতি উদযাপন এবং ওসামা বিন লাদেনকে মুসলিম বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ সেনাপতি ঘোষণা দেওয়া। এই সম্মেলনে পাকিস্তানের সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আসলাম বেগ ও সাবেক আইএসআই প্রধান জেনারেল হামিদ গুল উপস্থিত ছিলেন (সূত্র : জাহিদ হুসেন, ফ্রন্টলাইন পাকিস্তান, পৃষ্ঠা ৮১)।

মিসরে ব্রাদারহুড, ইন্দোনেশিয়ার জেমার ইসলামিয়া, আলজেরিয়ার ইসলামিক স্যালভেশন ফ্রন্ট এবং ফিলিপাইনের আবু সায়েফ গ্রুপের নেতারা এতে যোগ দেন। সুতরাং আফগানিস্তানে তালেবানের ক্ষমতা দখল মানেই হলো পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই, আল-কায়েদা এবং পাকিস্তান ভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বা ও জইশ-ই-মুহাম্মদের জন্য অবারিত সুযোগ সৃষ্টি হওয়া, যার মাধ্যমে তারা পূর্বের মতো পুরো জঙ্গি সন্ত্রাসী অপারেশন চালাতে সক্ষম হবে। ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের পর সেখান থেকে ফ্রি হয়ে হাজার হাজার সশস্ত্র মুজাহিদীন কাশ্মীরে প্রবেশ করে এবং জম্মু-কাশ্মীর লিবারেশন ফ্রন্টের উত্থান ঘটে ।

১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে তালেবান যখন কাবুলে ক্ষমতায় ছিল তখন লস্কর-ই-তৈয়বা ও জইশ-ই-মুহাম্মদের সশস্ত্র তৎপরতা শুধু কাশ্মীর নয় ভারতের মূল-ভূখণ্ডেও বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। এই প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনার পূর্বে কাশ্মীরের ঐতিহাসিক লেগেসির একটু সংক্ষিপ্ত উল্লেখ প্রয়োজন।

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন অবসানের প্রক্কালে উপমহাদেশে সাড়ে পাঁচ শতেরও বেশি ছোট-বড় প্রিন্সলি স্টেট বা স্বশাসিত রাজ্য ছিল। ক্যাবিনেট মিশন প্লান এবং বৃটিশ পার্লামেন্টে পাস হওয়া ভারতবর্ষ স্বাধীনতা আইনে বলা হয়, প্রিন্সলি স্টেটগুলো ইচ্ছা করলে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে থাকতে পারবে, অথবা ইচ্ছামত ভারত বা পাকিস্তানের সঙ্গে যোগ দিতে পারবে। প্রিন্সলি স্টেট হিসেবে কাশ্মীর স্বাধীন থাকার প্রস্তাব বেছে নেয়। কিন্তু ১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাসের শুরুতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী হঠাৎ করেই কাশ্মীর আক্রমণ করে। দ্রুতগতিতে কাশ্মীরের বিরাট এলাকা দখল হয়ে যাওয়ায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনী যখন শ্রীনগরের সন্নিকটে তখন কাশ্মীরের রাজা হরি সিং ভারতের সাহায্য চান। ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু স্পষ্ট বলে দেন কাশ্মীর ও পাকিস্তানের যুদ্ধে ভারত জড়িত হবে না। কাশ্মীরের রাজা হরি সিং তখন ভারতবর্ষ স্বাধীনতা আইনের ধারা অনুযায়ী ভারতের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার দলিলে ১৯৪৭ সালের ২৬ অক্টোবর স্বাক্ষর করেন, যেটিকে বলা হয় – Instrument of Accession of Jammu and Kashmir State.

তারপর ভারতীয় সেনাবাহিনী কাশ্মীর রক্ষার্থে সামরিক অভিযানে নামে। উপরোক্ত দলিলে মোট নয়টি অনুচ্ছেদ এবং চারটি শেডিউল রয়েছে, যাতে বিস্তারিতভাবে উল্লেখ আছে কী প্রেক্ষাপট ও পরিস্থিতিতে কাশ্মীর ভারতের সঙ্গে সংযুক্ত দলিলে স্বাক্ষর করেছে। তারপর জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় যুদ্ধ বিরতি হয়। তাতে কাশ্মীরের এক বড় অংশ পাকিস্তানের দখলে রয়ে যায়, যা আজও পাকিস্তানের দখলে আছে।

১৯৪৮ সালের ২১ এপ্রিল জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব নম্বর ৪৭ পাস হয়। তাতে কাশ্মীরের ভাগ্য নির্ধারণে সুনির্দিষ্ট তিনটি ধাপে কার্যক্রম গ্রহণের উল্লেখ করা হয়। প্রথম ধাপ – পাকিস্তানের সমস্ত সেনাবাহিনী এবং বেসামরিক লোকজন সম্পূর্ণভাবে কাশ্মীর থেকে প্রত্যাহার করতে হবে। দ্বিতীয় ধাপ – আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য যত সংখ্যক নিরাপত্তাবাহিনী রাখার প্রয়োজন হয় সেটি রেখে পর্যায়ক্রমে ভারত তার সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করবে। তৃতীয় ধাপ – সুষ্ঠু গণভোটের জন্য জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে ভারত একজন দক্ষ গণভোট প্রাধ্যক্ষ নিয়োগ দেবে। ব্রিটিশের ভারতবর্ষ স্বাধীনতা আইন অনুসারে পাকিস্তান অগ্রাসী পক্ষ ও দখলদার বাহিনী। এজন্যেই জাতিসংঘের ৪৭ নম্বর প্রস্তাবে পাকিস্তানের সামরিক বেসামরিক সকলকে প্রত্যাহারের জন্য গণভোটের পূর্ব শর্ত হিসেবে নিরাপত্তা পরিষদ গ্রহণ করে। কিন্তু পাকিস্তান দখলদারিত্ব বহাল রাখার কারণেই গণভোট হতে পারেনি।

ভারতবর্ষ স্বাধীনতা আইন এবং কাশ্মীরের পক্ষ থেকে স্বাক্ষরিত সংযুক্তি দলিল অনুসারে পুরো কাশ্মীর’ই ভারতের অংশ। হিন্দুস্তান টাইমসের সাবেক সম্পাদক অজিত ভট্টাচারিয়া কর্তৃক লিখিত – Sheikh Mohammad Abdullah – Tragic Hero of Kashmir গন্থের ২৫১ পৃষ্ঠায় শেখ আব্দুল্লাহর একটি উক্তি লিপিবদ্ধ আছে। তাতে শেখ আবদুল্লাহ বলেছেন, – In fact, the force of logic dictates the conclusion that the aggressor should withdraw his armed forces, and the UN should see that Pakistan get out of the state. সুতরাং দালিলিকভাবে প্রমাণিত যে পাকিস্তান দখলদারিত্ব বজায় রাখার কারণে কাশ্মীর সমস্যার সমাধান হচ্ছে না।

১৯৬৫ সালের যুদ্ধের সময় পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ছিলেন জেনারেল মোহাম্মদ মুসা। তিনি একটি বই লিখেছেন, যার শিরোনাম – Sepoy to General. জেনারেল মুসা তার বইতে স্বীকার করেছেন, আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ শুরুর প্রায় দুই-তিন মাস পূর্বেই কাশ্মীরি মুজাহিদ বাহিনীর ছদ্মবেশে পাকিস্তানের একটি কমান্ডো ব্যাটালিয়ন জম্মু ও কাশ্মীরের অভ্যন্তরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় এবং সেই সূত্র ধরেই যুদ্ধ বাঁধে । ১৯৯৯ সালে কারগিল যুদ্ধের প্রাক্কালেও পাকিস্তান একই কাজ করেছে । অর্থাৎ তিনটি যুদ্ধেই পাকিস্তান আক্রমণ করেছে, আগ্রাসী পক্ষ। কিন্তু তিন যুদ্ধে’ই পাকিস্তান শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছে । কিন্তু তাতে পাকিস্তানের মোল্লা ও মিলিটারির গোষ্ঠীর হুঁশ হয়নি।

তারা ধর্মীয় উত্তেজনা ছড়িয়ে ভারত ও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে এখনো বদ্ধপরিকর। সুতরাং তালেবান বাহিনী কাবুলে ক্ষমতা সুসংহত করার পরপরই তারা ১৯৮৯ সালের মতো কাশ্মীরের বিরুদ্ধে অভিযানে নামবে । তাতে যোগ দিবে লস্কর-ই-তৈয়বা ও জইশ-ই মুহাম্মদের মত সংগঠন। পূর্বের মত অপারেশন চালাবার দায়িত্বে থাকবে পাকিস্তান গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। আজকের পরিস্থিতি দেখে মনে হয় ২০১৯ সালের আগস্ট মাসে জম্মু-কাশ্মীরকে ইউনিয়ন টেরিটোরিতে রুপান্তরিত করে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার অত্যন্ত দূরদৃষ্টির পরিচয় দিয়েছে। কারণ ইউনিয়ন টেরিটোরি হাওয়ায় জম্মু-কাশ্মীরের নিরাপত্তার সম্পূর্ণ দায়িত্ব থাকবে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে। ২০১৯ সালে জম্মু-কাশ্মীরের কেন্দ্রীয় অঞ্চল ঘোষণার পরপর ক্ষণিক সময়ের জন্য জনজীবন স্থবির হয়ে পড়লেও দুই বছরের মাথায় এসে কাশ্মীরের জনগণ আবার ভাইব্রান্ট হয়েছে। যদিও পাকিস্তান cross-border টেরোরিজমের তৎপরতা কখনো বন্ধ রাখেনি, তবে কাবুলে তালেবান ক্ষমতা দখল করলে সেই তৎপরতা আরো বৃদ্ধি পেলে সব কিন্তু আবার পাল্টে যেতে পারে। তালেবানের মতো দানবীয় শক্তির উত্থান কারো জন্য ধূমকেতু নয়।

পুনশ্চ: আফগানিস্তানে পরিস্থিতি দ্রুত গতিতে পরিবর্তন হচ্ছে এবং অত্যন্ত ঘোলাটে। এই লেখাটি যখন শেষ করছি (১৫ আগস্ট রাতে) তখন খবরে দেখলাম আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি তাজিকিস্তানে পালিয়ে গেছেন এবং কাবুল ঘিরে ফলেছে তালেবান বাহিনী ।

লেখক: রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *