নিখিল মানখিন, ধূমকেতু বাংলা: স্বস্তিদায়ক হলেও করোনা নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার উপর গুরুত্বারোপ করেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, দেশে করোনা সংক্রমণ অব্যাহত রয়েছে। বিশ্বের অনেক দেশে করোনার তৃতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে। স্বাভাবিক অবস্থা ভাবার সময় এখনো আসেনি। ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হওয়ায় সংক্রমণের ভয়াবহ রূপ ফিরে আসতেও সময় লাগবে না। তাই বাইরে বের হলে ন্যূনতম মুখে মাস্ক পরতেই হবে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
দেশের সার্বিক করোনা পরিস্থিতি স্বস্তিকর অবস্থায় রয়েছে। গত তিন মাস ধরে করোনায় আক্রান্ত, শনাক্ত ও মৃতের হার হ্রাস অব্যাহত আছে। দৈনিক করোনা রোগী শনাক্তের হার এক শতাংশে এবং মৃতের হার দুই শতাংশে নেমেছে। করোনা রোগী সুস্থতার হার উঠে গেছে ৯৮ শতাংশে। বিশ্বের করোনা আক্রান্ত দেশগুলোর বিবেচনাতেও বাংলাদেশের উন্নতি ঘটেছে। তবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিশেষ করে মাস্ক পরিধান করার পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
দেশের করোনা ভাইরাসের সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা ধূমকেতু ডটকমকে জানান, চলতি বছরের গত ২২ নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে করোনায় আক্রান্ত ১৫ লাখ ৭৪ হাজার ৮৮ জনের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ২৭ হাজার ৯৫৩ জনের। সুস্থ হয়েছেন ১৫ লাখ ৩৮ হাজার ১৯৮ জন। পরীক্ষাগারের সংখ্যা বেড়েছে ৮৩৬টিতে উঠে এসেছে বলে জানান ডা. নাসিমা সুলতানা।
কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লা ধূমকেতু বাংলাকে বলেন, সংক্রমণ কমার সঙ্গে সঙ্গে স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়ে মানুষ উদাসীন হয়ে পড়েছে। মনে হয় যেন প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। দেশে করোনা সংক্রমণ অব্যাহত রয়েছে। বিশ্বের অনেক দেশে করোনার তৃতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে। স্বাভাবিক অবস্থা ভাবার সময় আসেনি। ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হওয়ায় সংক্রমণের ভয়াবহ রূপ ফিরে আসতেও সময় লাগবে না। তাই স্বাস্থ্যবিধি মানতেই হবে।
ন্যাশনাল ইমুনাইজেশন টেকনিক্যাল একপার্ট প্রুপের সদস্য অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ ধূমকেতু বাংলাকে বলেন, করোনা পরিস্থিতি ঝুঁকিমুক্ত হয়েছে-এমনটি চিন্তা করা ঠিক হবে না। একজন রোগী হলে তাকে আইসোলেটেড করা এবং তার সংস্পর্শে কারা কারা এসেছিলেন তার ট্রেসিং করার কথা রয়েছে। কিন্তু সেই চর্চাটা আমরা করছি না। ধীরে ধীরে মাস্ক পরার হার কমে যাচ্ছে। আমাদের কাছে আইন আছে, সুতরাং জাতীয় স্বার্থে তা প্রয়োগ করা দরকার। স্বাস্থ্যবিধি মানাতে সরকারকে আরো কঠোর হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন ডা. বে-নজির আহমেদ।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দীন আহমেদ ধূমকেতু বাংলাকে বলেন, করোনা নিয়ন্ত্রণে সফলতা দেখিয়েছে সরকার। সরকার তার কাজ আন্তরিকভাবে করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের সফল করোনা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে অবাক হয়েছে বিশ্ব। জীবন ও জীবিকার সমন্বয় ঘটানো হয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার দায়িত্ব সকলের। এটি নাগরিক দায়িত্ব।
তিনি বলেন, করোনা ভাইরাস সম্পর্কে আমরা কম-বেশি ধারণা পেয়ে গেছি। নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধের উপায়সমূহও জেনেছি। তাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে নিজেদের জীবন ও দেশের অর্থনীতি রক্ষার দায়িত্ব প্রত্যেক নাগরিককেই নিতে হবে।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্তণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এএসএম আলমগীর ধূমকেতু বাংলাকে বলেন, করোনা ভাইরাস নিয়ে গবেষণার শেষ নেই। এই ভাইরাসটি নিয়ে এখনও গবেষণা চলছে। করোনা ভাইরাসের আরও নতুন ভেরিয়েন্ট আসবে না- এমনটি ভাবাও ঠিক হবে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যেখানে এখনো করোনা ভাইরাস নিয়ে আতঙ্কমুক্ত হতে পারছে না, সেখানে ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশের পক্ষে দুশ্চিন্তামুক্ত থাকা যায় না।
স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ দিয়ে আইইডিসিআর কর্মকর্তা বলেন, দেশে করোনাময় স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে। অর্থাৎ করোনা ভাইরাস থেকেও যেন নেই্। করোনার বিষয়টি আমলে নিচ্ছে না মানুষ। কিন্তু করোনার ভয়াবহতা এতো তাড়াতাড়ি ভুলে গেলে চলবে না। ভয়াবহতা শুরু হয়ে গেলে দেশব্যাপী বিস্তার লাভ করতে সময় লাগবে না বলে সতর্ক করে দিয়েছেন এএসএম আলমগীর।
এদিকে, জাতিসংঘের হেলথ এজেন্সি জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় আমেরিকা, ইউরোপ ও এশিয়ায় নতুন আক্রান্তের হার ৬ শতাংশ বেড়েছে। গত এক সপ্তাহ ধরে বিশ্বের ৬১টি দেশে করোনায় আক্রান্তের হার বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে বলে জানিয়েছে সূত্রটি।
করোনা পরিস্থিতির অবনতিতে বিধিনিষেধ আরোপের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শনের ঘটনাও ঘটছে।
বিবিসি জানায়, ইউরোপে কোভিড-১৯ এর আক্রান্তের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বাড়া ঠেকাতে নতুন লকডাউন আইন ঘোষণার পর নেদারল্যান্ডসে আবার নতুন করে বিক্ষোভ ছড়িয়েছে। দ্য হেগ শহরে বিক্ষোভকারীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে জ্বলন্ত আতসবাজি ও পটকা ছুঁড়েছে এবং সাইকেলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। এর আগে গত শুক্রবার রাতে দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর রটারডামে করোনাভাইরাস বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে শত শত মানুষের বিক্ষোভ ভয়াবহ দাঙ্গায় রূপ নিলে পুলিশ গুলি চালায়। অস্ট্রিয়া, ক্রোয়েশিয়া এবং ইতালিতে নতুন বিধিনিষেধ জারির ঘোষণায় ক্ষুব্ধ হাজার হাজার বিক্ষোভকারী পথে নামে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, ইউরোপে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ যেভাবে বাড়ছে, তাতে তারা “অত্যন্ত উদ্বিগ্ন”।
ডা. নাসিমা সুলতানা বলেন, একদিনে সর্বোচ্চ নমুনা সংগ্রহ ২০২১ সালের ৩ আগস্টে ৫৭ হাজার ২৯৬টি এবং সর্বনিম্ন ২০২০ সালের ৫ এপ্রিলে ৩২০টি। সর্বোচ্চ পরীক্ষা ২০২১ সালের ৩ আগস্টে ৫৬ হাজার ২৮৪টি এবং সর্বনিম্ন ২০২০ সালের ২১ মার্চে ৩৬টি। সর্বোচ্চ রোগী শনাক্ত ২০২১ সালের ২৮ জুলাই ১৬ হাজার ২৩০ জন এবং সর্বনিম্ন ২০২০ সালের ৩০ মার্চে ১ জন। সর্বোচ্চ সুস্থ হয়েছে ২০২১ সালের ৮ আগস্টে ১৬ হাজার ৬২৭ জন এবং সর্বনিম্ন ২০২০ সালের পহেলা এপ্রিলে ১ জন। সর্বোচ্চ মৃত্যু ২০২১ সালের ৫ আগস্টে ২৬৪ জন এবং সর্বনিম্ন ২০২১ সালের ২০ নভেম্বর(কেউ মারা যায়নি)। সর্বোচ্চ শনাক্তের হার ২০২১ সালের ২৪ জুলাই ৩২ দশমিক ৫৫ শতাংশ এবং সর্বনিম্ন ২০২০ সালের ৩০ মার্চে দশমিক ৬৫ শতাংশ।
সর্বোচ্চ সুস্থতার হার ২০২১ সালের ২৬ অক্টোবর ৯৭ দশমিক ৭০ শতাংশ এবং সর্বনিম্ন ২০২০ সালের ২ মে দুই শতাংশ। সর্বোচ্চ মৃত্যুর হার ২০২০ সালের ২৫ মার্চে ১২ দশমিক ৮২ শতাংশ এবং সর্বনিম্ন ২০২০ সালের ৪ জুলাই ১ দশমিক ২৫ শতাংশ।
আরো পড়ুন:
চিকিৎসকদের প্রতি অনুরোধ, রোগীদের অযথা পরীক্ষা দেবেন না : স্বাস্থ্যমন্ত্রী