অভিমত

করোনা মহামারি পৃথিবী থেকে দূর হোক : মা দুর্গার কাছে এই হোক মোদের প্রার্থনা

তাপস হালদার:
একটি ভিন্ন প্রেক্ষাপটে এবারের দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বৈশ্বিক করোনা নামক মহামারী ভাইরাসের কারণে সারা পৃথিবীর মানুষের চলার গতি হয়ে আছে স্থবির। সামাজিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য মানুষ পরস্পরের সংস্পর্শ থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলছে। এমন কঠিন সময়ে দুর্গাপূজার আনন্দও ম্লান হবে, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। এবছর সকল স্বাস্থ্যবিধি মেনেই সর্বত্র দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

দুর্গাপূজা সমগ্র হিন্দু সমাজেই প্রচলিত। তবে বাঙ্গালী হিন্দু সমাজে প্রধান ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব। বাংলাদেশ, ভারত, নেপালসহ বিশ্বের যেখানেই বাঙ্গালী আছে সেখানেই জাঁকজমকের সাথে পালিত হয় দুর্গাপূজা। পারিবারিকভাবে দুর্গাপূজা সাধারণত ধনী বা বনেদী পরিবারগুলোতে আয়োজন হয়। যৌথভাবে বা এলাকা ভিত্তিক পূজাকে সর্বজনীন পূজা বলে। উপমহাদেশে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময় থেকে সর্বজনীন পূজা শুরু হয়। বর্তমানে দুর্গাপূজা পারিবারিক, বারোয়ারী ও সর্বজনীন তিন ধরণের হয়ে থাকে। মূলত দেবী দুর্গাকে দেশমাতা বা মাতৃভূমির জাতীয়তাবাদী বিপ্লবের ধারক মনে করা হয়। দেবী দুর্গার ভাবনা থেকেই সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিম চন্দ্র চট্রোপ্যাধায় ‘বন্দে মাতরম’ গানটি রচনা করেছেন। যা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের মূলমন্ত্র হয়ে উঠেছিল।

আরও পড়ুন: ঢাবি জগন্নাথ হল : ১৫ অক্টোবর শহীদদের স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা

দুর্গাপূজা আশ্বিন ও চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষে হয়ে থাকে। আশ্বিন মাস বা শরৎকালের পূজাকে শারদীয়া দুর্গাপূজা এবং চৈত্র মাসে বা বসন্তকালের পূজা বাসন্তী পূজা নামে পরিচিত। শারদীয় পূজাই সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত শারদীয় দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়।

সাধারণত মহালয়ার পাঁচ দিন পর দুর্গা পূজা শুরু হয়। এবার আশ্বিন মাসে দুটি অমাবস্যা পড়ে গেছে। একই মাসে দুটি অমাবস্যা পড়লে শাস্ত্রমতে মাসটি ‘মল’ মাস, মানে অশুভ মাস। মল মাসে কোনো পূজো হয় না, যে কোনো শুভ অনুষ্ঠানও হয় না। এজন্য এবার মহালয়ার পঁয়ত্রিশ দিন পর পূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সঙ্গত কারণেই শরৎকালের শারদীয় উৎসব হচ্ছে এবার হেমন্তকালে।

শাস্ত্রমতে, ২২ অক্টোবর সন্ধ্যায় ৬ষ্ঠী পূজোর মাধ্যমে দেবীর বোধন আর ২৬ অক্টোবর শুভ বিজয়ার মধ্য দিয়ে পূজার আনুষ্ঠানিকতা শেষ হবে।

মা দুর্গার এবার মর্ত্যে আগমন দোলায় চড়ে, যার ফলে পূজা শুরুর আগ পর্যন্ত মহামারি থাকবে। মা চলে যাবেন গজে, ধীর শান্ত হাতির পিঠে চড়ে স্বর্গে চলে যাবেন। যার ফলে শুভ বার্তা নেমে আসবে পৃথীবিতে। শস্য, শ্যামল হবে বসুন্ধরা।

দুর্গা বাঙ্গালীর ঘরের মেয়ে হলেও, তিনি দাপুটে নারী। তাঁর এক অঙ্গে বহু রূপ। বহু নামেও তিনি পরিচিত। শরৎকালে আগমন বলে দেবীর নাম শারদীয়। এছাড়াও কাত্যায়নী, মহিষাসুরমর্দিনী, শিবানী, ভবানী, আদ্যাশক্তি, দুর্গা, উমা, গৌরী, অম্বিকা, অদ্রিজাসহ আরো অনেক নামে ডাকা হয়। ঘরের মেয়ে পরিবারের একেক জন যেমন একেক নামে ডাকে তেমনি দেবী দুর্গা তো বাঙ্গালীর ঘরেরই মেয়ে। মা দুর্গাকে দশ হাতে যুদ্ধ করতে হয়েছিল মহিষাসুরকে বধ করতে। অসুর এখানে খারাপ বা দুষ্ট লোকের প্রতীক। সব দেবতারা অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছিল মা দুর্গাকে।

দশমীর দিন বাংলাদেশে সরকারী ছুটি থাকে। সংবাদপত্রগুলো বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রচার করে। টেলিভিশনগুলো পাঁচ দিনই পূজোর অনুষ্ঠান প্রচার করে থাকে। দশমীর দিনে চলে বিসর্জনের আয়োজন। সারাদিন নানা আয়োজনের পর শোভাযাত্রা করে নদী, খাল, পুকুরে বিসর্জন দেয়া হয়। এর মধ্য দিয়ে পাঁচদিন ব্যাপী দুর্গোৎসবের সমাপ্তি ঘটে।

বৈশ্বিক করোনা পরিস্থিতির কারণে এবারের শারদীয় দুর্গাপূজা স্বাস্থ্যসুরক্ষা বিধি মেনে অনুষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় পূজা উদযাপন পরিষদের পক্ষ থেকে ২৬ দফা ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে ১১ দফা নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। অনাড়ম্বরভাবে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যে পূজা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা বলা হয়েছে।

নির্দেশনায় আরো বলা হয়েছে, সব ধরণের আলোকসজ্জা, সাজসজ্জা, মেলা, আরতি প্রতিযোগিতা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিহার; সম্ভব হলে বাসায়/বাড়িতে বসে ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহার করে অঞ্জলি প্রদান, খোলা জায়গায় প্যান্ডেলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা; প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, জনপ্রতিনিধি ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে মন্দির/মন্ডপ কেন্দ্রীক শৃঙ্খলা রক্ষা কমিটি; প্রতিমা বিসর্জনে শোভাযাত্রা পরিহার। ভক্তিমূলক গান ছাড়া অন্য গান পরিহার করা; আতশবাজি, পটকা, মাইক পরিহার; সন্ধ্যা আরতির পর দর্শনার্থী প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা। পরিস্থিতির কারণে এসব নির্দেশনা না মানার উপায়ও উপায় নেই।

দুর্গাপূজা সনাতন ধর্মের ধর্মীয় উৎসব হলেও কালের পরিক্রমায় এটি আজ জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকল বাঙ্গালীর উৎসবে পরিণত হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা বারবার বলেছেন, ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’। বর্তমান সরকারের সময়ে সে পরিস্থিতিটাই তৈরি হয়েছে। ঈদ ও পূজা এখন কেবল বিশেষ কোন ধর্মের উৎসব নয়। সমগ্র বাঙ্গালীর প্রাণের উৎসবে পরিণত হয়েছে।

অশুভ শক্তিকে পরাজিত করে সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ থাকুক প্রিয় বাংলাদেশ। মানুষে মানুষে সম্প্রীতির বন্ধন আরো সুদৃঢ় হোক। সকল অশুভ শক্তির বিনাশ হোক। করোনা নামক মহামারি পৃথিবী থেকে দূর হোক। মা দুর্গার কাছে এই হোক মোদের প্রার্থনা।

লেখক: সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ ও সাবেক ছাত্রনেতা।

ইমেইল: haldertapas80@gmail.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *