ডেস্ক রিপোর্ট, ধূমকেতু ডটকম: করোনাভাইরাস মোকাবেলায় সারাদেশে গণটিকা কার্যক্রম
শুরুর পর মানুষের মধ্যে আগ্রহ বেড়েছে। কিন্তু গ্রামীণ এলাকায় এখনো টিকার ব্যাপারে
ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টি হয়নি। ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী হিসেবে টিকা কর্মসূচির আওতার মধ্যে
আরও পড়ুন: পটুয়াখালীর প্রত্যন্ত দ্বীপ চরমোন্তাজে বিদ্যুতায়ন শুরু | দ্বীপবাসীর আনন্দ প্রকাশ
পড়লেও অনেকেই জানেন না টিকা কোথায় দিচ্ছে, কীভাবে পাওয়া যাবে। টিকা নেবেন কিনা
তা নিয়ে কারো কারো মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাজ করছে এখনো।
এ ব্যাপারে জনসচেতনা সৃষ্টিতে গ্রামগঞ্জে সবখানে এখনো প্রচারাভিযান শুরু হয়নি। সরেজমিনে
একটি উপজেলার টিকা কার্যক্রম ঘুরে এবং গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।
সরজমিনে মুন্সীগঞ্জ
গ্রামীন এলাকায় টিকা কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করতে বিবিসির সংবাদদাতা গিয়েছিলেন মুন্সীগঞ্জ
জেলার টংগীবাড়ী উপজেলা এবং আশপাশের গ্রামে। চতুর্থ দিনে টিকা কার্যক্রম পরিদর্শনে গিয়ে
দেখা যায় নির্ধারিত সময়ের পরেও সকালে টিকা দেয়া শুরু হয়নি, কারণ দশজন নিবন্ধিত
ব্যক্তি না আসায়।
স্বাস্থ্যকর্মীরা জানান একটি ভায়েলে দশ ডোজ টিকা থাকে। একসঙ্গে দশজন না হলে অব্যহৃত
ডোজ নষ্ট হতে পারে এমন আশঙ্কা রয়েছে। একটি ভায়েল খোলা হলে সর্বোচ্চ ৬ ঘণ্টা পর্যন্ত
এর গুনাগুন ঠিক থাকে বলে তারা দশজনের নিবন্ধন একসঙ্গে করে টিকা দেন।
সকাল সাড়ে দশটার দিকে শুরু হয় টিকা কার্যক্রম। স্বাস্থ্যকর্মীসহ চল্লিশোর্ধ যারা টিকা নিলেন
তাদের মধ্যে বেশিরভাগই আশপাশের এলাকা থেকে এসেছেন। টিকা নেয়ার পর একজন
বলছিলেন প্রথমদিকে একটা আশঙ্কা ছিল যে, কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয় কিনা। তবে যখন
তার সহকর্মীরা নিয়েছেন এবং টিভিতে অনেককেই টিকা নিতে দেখেছেন তখন সাহস করে
টিকা নিলেন।
আরেকজন গৃহিণী হাসিনা বেগম বলেন, “দেয়ার আগে একটু ভয় লাগতো, দেয়ার পরে তেমন
কোনো ভয় লাগে নাই, ব্যথাও লাগে নাই।”
স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রেজিস্ট্রেশন করতে আসা ব্যবসায়ী শাহিন খান বলেন, প্রথম প্রথম ভয় ছিল এখন
ভয়টা কেটে গেছে। “অলরেডি মন্ত্রী মিনিস্টার বা উপরের লেভেলে যারা আছে তারা টিকা
দিতাসে, তাইলে আমরাও দেবো কোনো সমস্যা নাই।”
কিন্তু একই জায়গায় দেখা গেল অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা নিতে দূর দূরান্ত থেকে আসা অনেকেই
টিকার ব্যাপারে একেবারেই কিছু জানেন না। ৮০ বছরের বৃদ্ধ শ্বশুরকে চিকিৎসা শেষে বাড়ী
ফিরে যাচ্ছিলেন আসমা। যাবার পথে জিজ্ঞেস করেছিলাম করোনাভাইরাসের টিকা সম্পর্কে।
তিনি জানান, বয়স্ক মানুষকে যে টিকা দিচ্ছে তিনি সেটাই জানেন না।
“আপনাগো কাছ থেকেই শুনলাম। আর এখানে আসার পর এখন পর্যন্ত কেউ কয় নাই যে
বয়স্ক মানুষরে টিকা দেয়া হইতাছে। আপনেই ধরলেন, আপনেই কইলেন।”
যদিও পাশে থাকা তার অসুস্থ শ্বশুর হাঁটতে হাঁটতে বলছিলেন, “আরে এমনিতেই মইরা যাব
আর টিকা দিয়ে কী হইবো!।”
স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসা নিতে আসার আরেকজন নারী বলছিলেন, তারা জানেন না যে ৪০ বছর
বয়সের বেশি সাধারণ মানুষকেও টিকা দেয়া হচ্ছে। অনলাইনে নিবন্ধন করে যে কেউ টিকা
নিতে পারেন।
টিকা কেন্দ্রে অনেকেই আবার অনলাইনে নিবন্ধন না করেই উপস্থিত হয়েছেন। দেখা গেল
জাতীয় পরিচয়পত্র যাদের সঙ্গে আছে তাদেরকে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিবন্ধনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
উপজেলার মানুষেরা এই সুবিধা পেয়ে অনেকটা উপকৃত হচ্ছেন। যদিও বৃহস্পতিবার থেকে
কেন্দ্রে নিবন্ধন ব্যবস্থা বন্ধ করে দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
উপজেলা স্বাস্থ্যকর্মকর্তা ডা. তাসলিমা ইসলাম বলেন, সম্মুখসারির কর্মী এবং সাধারণ
জনগোষ্ঠীর বয়সসীমা ৫৫ বছর থেকে ৪০ বছরে নামিয়ে আনায় আগ্রহ বাড়ছে।সাধারণ
মানুষকে আগ্রহী করতে জোর দেয়া হচ্ছে প্রচার প্রচারণায়।
“মানুষের শারীরিক পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হয় কিনা এটা একটু জনগণ দেখতে চাচ্ছে। তবে আগের
চেয়ে আগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমরা প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছি, স্বাস্থ্যকর্মীদের মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চলে
ঘরে ঘরে তথ্য দিতে বলেছি।”
এদিকে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে টিকা নিতে আসা বেশিরভাগ মানুষই ছিল উপজেলা সদরের আশপাশের
এলাকার।উপজেলা থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে গ্রাম এলাকায় গিয়ে কথা বলে বোঝা যায়
টিকা নিয়ে গ্রামের সাধারণ মানুষেরা তেমন কোন তথ্যই জানেন না। শুধু টিকা আসছে এমন
খবর লোকমুখে শুনেছেন। কিছু বিভ্রান্তিকর তথ্যও শুনেছেন কেউ কেউ।
গ্রামের একটি মসজিদে জোহরের নামাজের পর কয়েকজন মুসল্লী এবং ইমামের সঙ্গে কথা
বলেও জানা গেল টিকার ব্যাপারে কোনো প্রচার প্রচারণা হচ্ছে না। মসজিদে কোনো বয়ান বা
খুতবার বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো নির্দেশনা পৌঁছায়নি।
টিকার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জনমত গঠনে বা যেকোন বিভ্রান্তি দূর করতে বড় ভূমিকা
থাকে গ্রামের মসজিদের ইমাম শিক্ষকদের মতো ব্যক্তিরা।তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় এটি
নিয়ে মানুষ তাদের কাছে জানতে চান তবে প্রশাসনিক কোনো নির্দেশনা তারা পাননি এখনো।
খেতের পাড়া জামে মসজিদের ইমাম মো. কামরুজ্জামান বলেন, “আমরা ইমাম আছি আমাদের
মাধ্যমে যদি মুসল্লীদের বলি তাহলে সমাজের মুসল্লীরা শুনতে পায়, জানতে পারে।”
“এটার উপকারিতাটা যদি আমরা ভাল মনে করি তাহলে সবাই এটা নেয়ার জন্য আগ্রহী
হবে। আর ভাল মনে না করলেতো কেউ নিবে না। ভাল জিনিসটার প্রচার হওয়া দরকার।”
বাড়ি বাড়ি আসলে টিকা নেবেন তারা
টংগিবাড়ী উপজেলা একটি স্কুলের আইসিটি শিক্ষক মো. গোলাম সরওয়ার বলছিলেন, “সাধারণ
পাবলিক এখনো মনে করে যে টিকা দিতে টাকা লাগবে। অনেকেই আমার কাছে আসছে যে
স্যার কত টাকা খরচ হবে?”
“আমি বলছি যে কোনো টাকা লাগবে না। সবচেয়ে বেশি সমস্যাটা হইছে সবাই জানে যে,
টিকা শুধু সম্মুখ সারির মানুষকে দেয়া হবে। সাধারণ পাবলিক পাবে এই জিনিসটা এখনো
প্রচার হয় নাই। আমার মনে হয় এইটা প্রচার হওয়া উচিৎ।”
এছাড়া গ্রামের অনেকেই বলেছেন, তাদের অনেকের পক্ষে উপজেলায় গিয়ে টিকা নেয়া সম্ভব
নয়, শিশুদের যেমন বাড়ির কাছে টিকা দেয়া হয় সেভাবে এলে তারা টিকা নেবেন।
অন্যদিকে সাধারণ মানুষের মধ্যে এমনো কেউ কেউ আছেন যাদের টিকা নেয়ার প্রয়োজন
কিন্তু তারা এখনো টিকা নিতে মোটেও আগ্রহী নন।এই গোষ্ঠীকে টিকার আওতায় নিয়ে আসা
একটা বড় চ্যালেঞ্জ হবে। শুধুমাত্র গতানুগতিক প্রচার-প্রচারণায় এসব মানুষের মনোভাব
পরিবর্তন সম্ভব নয় বলেই মনে হয়েছে।
মুন্সীগঞ্জ জেলার সিভিল সার্জন ডা. মো. আবুল কালাম আজাদ মনে করছেন দিন দিন
যেভাবে টিকায় আগ্রহ বাড়ছে তাতে প্রাথমিক লক্ষ্য পূরণ সম্ভব হবে।
গণটিকা কার্যক্রম শুরুর প্রথম সপ্তাহে ৩ লাখ ৩৭ হাজার ৭৬৯ জন টিকা
নিয়েছেন আর টিকা পেতে নিবন্ধন করেছেন সাড়ে ১১ লাখের বেশি মানুষ। অনলাআইনে
নিবন্ধন প্রতিঘণ্টায় বাড়ছে।