স্বাস্থ্য

করোনা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে ব্যাপক সফলতা পেয়েছে বাংলাদেশ

নিখিল মানখিন, ধূমকেতু বাংলা: করোনাভাইরাসের ধাক্কা সামাল দিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর শীর্ষে উঠে আসার পাশাপাশি বিশ্বের অনেক উন্নত দেশকেও পেছনে ফেলে দিয়েছে বাংলাদেশ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা, টিকাদান কর্মসূচি এবং সামাজিক সচেতনতামূলক কার্যক্রমে দেশের মানুষের জোরালো অংশগ্রহণ সফলতার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। সীমিত সম্পদ ও আয়তনের বিপরীতে বিপুল জনসংখ্যাকে নিয়ে বাংলাদেশের এই সাফল্যে ইতোমধ্যে বিস্ময় প্রকাশ করেছে বিশ্ববাসী। করোনায় মৃত্যু সংখ্যার (ক্রমানুসারে) বিবেচনায় বাংলাদেশের স্থান ২৯তম। পরীক্ষিত নমুনা সংখ্যার ভিত্তিতে শনাক্তকৃত রোগী সংখ্যার দিকে দিয়ে ৩১তম স্থানে রয়েছে। গত ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার শূন্য দশমিক ৯৫ শতাংশ মানুষের শরীরে করোনা শনাক্ত হয়েছে।

আয়তনের তুলনায় কম জনসংখ্যার ঘনত্ব নিয়েও করোনা মোকাবেলায় হিমশিম খাচ্ছে বিশ্বের অনেক উন্নত দেশ। বুধবার দুপুরে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যানভিত্তিক ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডোমিটারের প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, মোট শনাক্তকৃত রোগী সংখ্যার বিবেচেনায় বিশ্বে করোনায় আক্রান্ত দেশগুলোর মধ্যে ভারত ২য়, বাংলাদেশ ৩১তম, পাকিস্তান ৩৪তম, নেপাল ৪৭তম, শ্রীলংকা ৬০তম, মালদ্বীপ ১১৬তম ও ভুটান রয়েছে ২০৪তম স্থানে। এই ধারা অনুযায়ী, অবস্থান যতই সামনের দিকে যাবে, ওই দেশের করোনা পরিস্থিতির ততই অবনতি ঘটবে।

ওয়ার্ল্ডোমিটার আরও জানায়, মোট পরীক্ষিত নমুনার ভিত্তিতে শনাক্তের হার ভারতে ৫. ২০ শতাংশ, মোট মৃত্যু ৪,৭৮,৩২৫ জন, সুস্থতার হার ৯৮.৩৯ শতাংশ। বাংলাদেশ শনাক্তের হার ১৩.৯৮ শতাংশ, মোট মৃত্যু ২৮,০৫১ জন, সুস্থতার হার ৯৭.৭৫ শতাংশ। পাকিস্তানে শনাক্তের হার ৫.৬২ শতাংশ, মোট মৃত্যু ২৮,৮৯২ জন, সুস্থতার হার ৯৭  শতাংশ। নেপালে ১৭.২৬ শতাংশ, মোট মৃত্যু ১১,৫৭৭ জন, সুস্থতার হার ৯৭.৯৬ শতাংশ। শ্রীলংকায় ১০.১৪ শতাংশ, মোট মৃত্যু ১৪,৭৯৫ জন, সুস্থতার হার ৯৬ শতাংশ। ভুটানে ০.২০ শতাংশ, মোট মৃত্যু ৩ জন, সুস্থতার হার ৯৯.৩৯ শতাংশ। মালদ্বীপে ৫.১২ শতাংশ, মোট মৃত্যু ২৬০ জন, সুস্থতার হার ৯৭.৬৬ শতাংশ।

ওয়ার্ল্ডোমিটার আরও জানায়, মোট জনসংখ্যার আক্রান্ত ভারতে ২.৫৭ শতাংশ, বাংলাদেশে ০.৯৫ শতাংশ, পাকিস্তানে ০.৬১ শতাংশ, নেপালে ২.৯৭ শতাংশ, শ্রীলংকায় ২.৬৪ শতাংশ, মালদ্বীপে ২১.৯০ শতাংশ, ভুটানে ০.৩৩ শতাংশ।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জনসংখ্যা:

বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫৭ লাখ এবং জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গ কিলোমিটারে প্রায় ১১১৬ জন। ভারতের জনসংখ্যা প্রায় ১৩৫ কোটি এবং জনসংখ্যার ঘনত্ব ৪৬৪ জন প্রতি বর্গকিলোমিটারে। পাকিস্তানের জনসংখ্যা ২১ কোটি ৭ লাখ এবং জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে ২৩৯ জন। নেপালের জনসংখ্যা ২ কোটি ৯০ লাখ এবং জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১৮০ জন। ভুটানের জনসংখ্যা প্রায় ৭ লাখ ৯৭ হাজার ৭৬৫ জন এবং জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৪৫ জন। মালদ্বীপের জনসংখ্যা প্রায় ৪ লাখ ৩০ হাজার এবং জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রায় ১১০৫ জন প্রতি বর্গকিলোমিটারে। শ্রীলংকার জনসংখ্যা প্রায় ২ কোটি ২০ লাখ এবং জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৩২৭ জন।

করোনা মোকাবেলার সফলতায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর শীর্ষে বাংলাদেশ

করোনা মোকাবেলার সফলতায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর শীর্ষে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা, টিকাদান কর্মসূচি এবং সামাজিক গতিশীলতার ওপর ভিত্তি করে বৈশ্বিক এই সূচক করে থাকে জাপানের শীর্ষস্থানীয় ইংরেজি দৈনিক নিক্কি এশিয়া। বিশ্বের ১২১টি দেশ ও অঞ্চলের করোনাভাইরাস পরিস্থিতি পর্যালোচনার পর চারটি মানদণ্ডের ভিত্তিতে এই সূচক তৈরি করা হয়। এতে দেশগুলোর প্রাপ্ত স্কোর ০ থেকে ৯০-এর মধ্যে।

প্রকাশিত নিক্কি কভিড-১৯ রিকভারি সূচক অনুযায়ী আগেরবারের তুলনায় এবার বাংলাদেশের ৪৮ ধাপ উন্নতি হয়েছে। ১২১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ বর্তমানে ২৬তম স্থানে রয়েছে। বাংলাদেশ ৯০ স্কোরের মধ্যে ৬০ পেয়ে দক্ষিণ এশিয়ার ছয়টি দেশের মধ্যে শীর্ষে অবস্থান করছে। এই অঞ্চলে বাংলাদেশের পর দ্বিতীয় স্থানে আছে পাকিস্তান; করোনা মোকাবেলায় দেশটি ৫৮.৫ স্কোর পেয়েছে। বৈশ্বিক হিসাবে পাকিস্তানের অবস্থান ৩৩তম। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ ভারত তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। দেশটির বৈশ্বিক অবস্থান ৪০তম। এরপর রয়েছে নেপাল ৪৪তম ও শ্রীলঙ্কা ৬১তম।

এই অঞ্চলে সবচেয়ে তলানিতে আছে যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান। বিশ্বে দেশটির অবস্থান ৯৭তম। নিক্কি এশিয়ার এর আগের সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৭৪তম। গত মাসে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গের কভিড রেজিলিয়েন্স বা কভিড সহনশীলতা সূচকে পাঁচ ধাপ এগিয়ে বিশ্বের ৫৩টি দেশের মধ্যে ৩৯তম অবস্থানে উঠে আসে বাংলাদেশ।

করোনা মোকাবেলার জন্য গঠিত জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শহিদুল্লা ধূমকেতু বাংলাকে বলেন, করোনা মোকাবেলায় বাংলাদেশের সফলতা বিশ্বের অনেক উন্নত দেশকে পেছনে ফেলে দিয়েছে। বাংলাদেশের জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় ১২০০ জন। জনসংখ্যায় বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম। সীমিত সম্পদ ও আয়তনের বিপরীতে বিপুল জনসংখ্যাকে নিয়ে বাংলাদেশের এই সাফল্যে ইতোমধ্যে বিস্ময় প্রকাশ করেছে বিশ্ববাসী।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি এবং সেগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়নের কারণেই করোনা মোকাবেলায় বাংলাদেশ সফলতা পেয়েছে জানিয়ে অধ্যাপক শহিদুল্লা বলেন, এই সফলতার পেছনে প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী পরিকল্পনা গ্রহণ এবং সেগুলোর সৃশৃঙ্খল বাস্তবায়ন কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। প্রধানমন্ত্রী নিজে সব কিছু মনিটরিং করেছেন। জীবন ও জীবিকা রক্ষায় সমন্বয় ঘটিয়ে তিনি করোনা মোকাবেলা করে যাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা পেয়ে সরকারি ও বেসরকারি  উদ্যোগে গড়ে তোলা হয় শক্তিশালী করোনা প্রতিরোধ কার্যক্রম। করোনা সংক্রমণ রোধের পাশাপাশি আক্রান্তদের চিকিৎসা সেবা প্রদানে বৃদ্ধি করা হয় জনবল, চিকিৎসক, উপকরণ ও চিকিৎসা অবকাঠামোর পরিধি। লকডাউন ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছুটি থাকায় বাইরে বের হতে পারেনি অনেকে। অর্থাৎ সরকারি নির্দেশনা পালনে দেশবাসী সাড়া দেয়ায় করোনার সংক্রমণ চরমভাবে ব্যাহত হয়।

জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির নির্দেশনাসমূহের বিষয়টি তুলে ধরে অধ্যাপক শহিদুল্লা বলেন, করোনা মোকাবেলা করতে প্রায় ৪৯ বার গুরুত্বপূর্ণ মিটিং করেছে পরামর্শক কমিটি। গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ  দিয়ে  সরকার ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সমূহকে সহযোগিতা প্রদান অব্যাহত করেছে এই কমিটি। করোনায় মোকাবেলায় পৃথিবীর অন্য কোনও দেশে এমন বিশেষ কমিটি গঠিত হয়নি। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন এবং তাতে দেশবাসীর সহযোগিতা থাকায় করোনা প্রতিরোধে ব্যাপক সফলতা পেয়েছে বাংলাদেশ।

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আাইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক ডা. এএসএম আলমগীর ধূমকেতু বাংলাকে বলেন, নানা আলোচনার মাঝেও করোনা মোকাবেলায় অনেক কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে পেরেছে বাংলাদেশ। প্রথম দিকে দেয়া লকডাউন অনেক কাজে লেগেছে। লকডাউনের কারণে লোকজন বাইরে বের হতে পারেনি। স্বাস্থ্যবিধি পালন করেছে অধিকাংশ মানুষ। বাইরে কম হলেও সরকারি নির্দেশনার কারণে এখন পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারি কর্মস্থলে ন্যূনতম মাস্ক ব্যবহারে বাধ্যবাধকতা রয়েছে, যা সংক্রমণরোধে ভূমিকা রাখছে। লকডাউনের আগে ও পরে নানা সমস্যায় পড়ে যারা শহর ছেড়ে গ্রামে গিয়েছে তাদের অনেকেই আর শহরে ফিরে আসেনি। অতি প্রয়োজন ছাড়া এক বাসা থেকে অন্য বাসায় এবং একজনের কাছে আরেকজনের আসা-যাওয়া দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ ছিল। নিষেধাজ্ঞা নয়, করোনার কারণে প্রত্যেক মানুষের মনে এমন মানসিকতা সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল। সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। অকারণে ঘুরাঘুরি করা লোকজনের সংখ্যা ছিল কম। করোনা ভাইরাস সংক্রমণে বাহকের সংখ্যাও কমে গিয়েছিল।

তিনি অরও বলেন, সরকারি উদ্যোগে জাতীয়, বিভাগীয়, জেলা, উপজেলা, গ্রাম ও ওয়ার্ড পর্যায়ে গড়ে ওঠে করোনা প্রতিরোধ কমিটি। এভাবে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে পরিচালিত করোনা প্রতিরোধ কার্যক্রম বাস্তবায়নে অনেক সহযোগিতা করেছে দেশবাসী। ফলে এসেছে সফলতা।

 আরো পড়ুন:

বুস্টার ডোজ নিতে নতুন করে নিবন্ধনের প্রয়োজন নেই : সেব্রিনা ফ্লোরা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *