অভিমতস্বাস্থ্য

করোনা ঠেকাতে মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনাই চ্যালেঞ্জ দেশে দেশে

ইব্রাহীম খলিল জুয়েল:

মেডিকেল বর্জ্য থেকে যেন করোনা ভাইরাসের বিস্তার না ঘটে সে দিকটি ভাবিয়ে তুলেছে বিশ্বের সকল স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের। করোনা মহামারির প্রভাবে সব দেশেই পাল্লা দিয়ে বড় হচ্ছে মেডিকেল বর্জ্যের স্তুপ। বিশেষ করে ব্যাপকভাবে আক্রান্ত দেশগুলোর সামনে এটা এখন একটি বড় চ্যালেঞ্জ। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, স্পেন, ইতালি, ফ্রান্স, চীন, ভারত, বাংলাদেশসহ আক্রান্ত বিশ্বের দুই শতাধিক দেশের জন্য এটি এখন বাড়তি দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশী-বিদেশী গণমাধ্যমে এ সংক্রান্ত প্রকাশিত খবরে এমনটাই বলা হচ্ছে।

নিয়মিত গৃহস্থালী ও হাসপাতাল বর্জ্যের পাশাপাশি করোনার কারণে সৃষ্ট বাড়তি ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্যের ব্যবস্থাপনা করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে গোটা বিশ্ব। করোনা আক্রান্ত রোগীর বর্জ্য থেকে ব্যাপক আকারে করোনা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। যার একটি উদাহরণ বলে মনে করা হয় বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জকে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দ্রুত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করতে না পারার কারণে, কিংবা নোংরা পরিবেশের কারণে নারায়ণগঞ্জে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বেশি।

রোগীর ব্যবহৃত কাপড়-চোপড়, টিস্যু, মাস্ক, স্যালাইন, ইনজেকশনের সিরিঞ্জ, ওষুধের মোড়ক, বিছানাপত্র ছাড়াও চিকিৎসক, নার্স এবং অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যবহৃত পিপিই, টিস্যু, মাস্ক- এ সবই এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্য।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের স্বাস্থ্য-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সংকট হচ্ছে জায়গার অভাব। স্থান ও লোকবল সংকটে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বর্জ্য নিষ্কাশন ও পরিশোধন।

যেমন- চীনের উহানে যখন করোনা ছড়িয়ে পড়লো তখন শুধু উহানেই দৈনিক ২৪০ মে. টন বর্জ্য তৈরি হতো। যা নিয়মিত বর্জ্যের চেয়ে ৬ গুণ বেশি। এটা সামলাতে চীন বর্জ্য পুড়িয়ে ফেলার পদক্ষেপ নেয়। জানুয়ারির শেষ দিক থেকে চলতি সপ্তাহ পর্যন্ত চীন সারা দেশে ১ লাখ ৫৯ হাজার টন বর্জ্য ধ্বংস করেছে। এই পরিস্থিতিতে সব দেশই মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য যার যার দেশের বাস্তবতায় গাইডলাইন জারি করে।

মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ঝুঁকি ::

কোভিড-১৯ আক্রান্তদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে রোগীরা ছাড়াও চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যবহৃত সরঞ্জামের বেশিরভাগই দ্বিতীয়বার ব্যবহারের সুযোগ নেই। ফলে অস্বাভাবিক গতিতে বাড়ছে হাসপাতাল বর্জ্য।

অদৃশ্য করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে সবচেয়ে সামনে থেকে লড়ছেন চিকিৎসক আর স্বাস্থ্যকর্মীরা। নিজে সুস্থ থাকলেই কেবল তারা চিকিৎসা দিতে পারবেন রোগীদের। ছোঁয়াচে ভাইরাস থেকে নিরাপদ থাকতে দরকার হচ্ছে বিপুল পরিমাণ মেডিকেল মাস্ক, গাউনসহ বিশেষ সুরক্ষা পোশাক। ব্যক্তিগত সুরক্ষা পোশাক বা পিপিই’র বেশির ভাগই মাত্র একবার ব্যবহারযোগ্য এবং ব্যবহারের সাথে সাথেই নষ্ট করে ফেলার নিয়ম। যতো বেশি রোগী, ততো বেশি ব্যবহৃত ডিসপোসেবল পিপিই এবং ততো বেশি মেডিকেল বর্জ্য।

ব্যবহৃত ও দূষিত চিকিৎসা সরঞ্জাম এবং পোশাক যেসব কন্টেইনারে রাখা হয়, সংক্রমণ এড়িয়ে সেগুলো মজুদ করা এবং ধুয়ে পরিস্কার করে পরবর্তীতে ব্যবহারযোগ্য করতে বড় জায়গা দরকার।

মেডিকেল বর্জ্য অস্বাভাবিক বেড়ে গেলেও সে অনুপাতে জায়গা নেই। সেটাই এখন বিশ্ববাসীর সবচেয়ে বড় সমস্যা। কেবল মেডিকেল বর্জ্য নয়, লকডাউনে পৃথিবীর অর্ধেকের বেশি মানুষ গৃহবন্দী রয়েছে বলে বাড়ছে গৃহস্থালী বর্জ্যও। মৃদু উপসর্গের করোনার রোগী কিংবা উপসর্গবিহীন ভাইরাস-বাহকদের দ্বারাও করোনা ছড়াতে পারে গৃহস্থালী বর্জ্যের মাধ্যমে।

বাংলাদেশ পরিস্থিতি ::

বাংলাদেশে গৃহস্থালী ও হাসপাতাল বর্জ্য থেকে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীরা বাসাবাড়িতে কোয়ারেন্টাইনে আছেন। কোথাও কোথাও আইসোলেশনও বাসাতেই হচ্ছে। এছাড়া দেশের সব হাসপাতালের আবর্জনাও আলাদাভাবে সংগ্রহ করে ব্যবস্থাপনা করার পদ্ধতি গড়ে ওঠেনি।

এ অবস্থায় করোনা রোগীদের ব্যবহৃত টিস্যু বা অন্য বর্জ্য সাধারণ বর্জ্যের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। এতে পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের মাধ্যমে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। এ ব্যাপারে সতর্ক হওয়ার পাশাপাশি এই ঝুঁকি মোকাবেলায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

দেশের ১২টি সিটি কর্পোরেশন এবং ৩২৮টি পৌরসভায় স্বাস্থ্যসম্মতভাবে বাসাবাড়ি থেকে বর্জ্য সংগ্রহ করা হলেও মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার চিত্র বেহাল। ঢাকা, টঙ্গী এবং নারায়ণগঞ্জের মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য একটি কাঠামো গড়ে উঠলেও সেটা ১ হাজার ৫০০ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সর্বোচ্চ ১ হাজার প্রতিষ্ঠানের বর্জ্য সংগ্রহ করতে পারে। বাকি প্রতিষ্ঠানের বর্জ্য সাধারণ বর্জ্যের সঙ্গে মিশে ল্যান্ডফিলে ফেলা হয়।

অন্য দিকে দেশের বৃহৎ অংশ জুড়ে থাকা ৪ হাজার ৫৭১টি ইউনিয়নে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার তেমন কোনো কাঠামো এখনো গড়ে ওঠেনি। করোনা ভাইরাস দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ায় গ্রামবাংলায় যত্রতত্র ফেলানো বর্জ্য থেকেও ভাইরাস ছড়ানোর ঝুঁকি রয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন

দেশের সামগ্রিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার চিত্র সম্পর্কে স্থানীয়সরকার মন্ত্রী মোঃ তাজুল ইসলাম বলেন, বর্জ্য থেকে করোনা ভাইরাস ছড়াচ্ছে কিনা, এখনও সেটা প্রমাণিত নয়। তবে যেভাবে ছড়ায় বলে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তাতে করে বর্জ্য থেকে করোনা ভাইরাস ছড়ানো অসম্ভব কিছু নয়। এ ব্যাপারে আমরা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে সতর্ক করবো। এছাড়া দেশবাসীকে সতর্ক এবং সচেতন করতে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক বলেন, গৃহস্থালীর বর্জ্য বা হাসপাতাল বর্জ্য যাই বলি না কেন, আবর্জনা বা নোংরা পরিবেশ থেকে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়া শুরু হয়েছে। নারায়ণগঞ্জ তার বড় উদাহরণ। তিনি বলেন, এ সময় বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আরও সতর্ক হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। এসব ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। নইলে পরিস্থিতি খারাপ হয়ে যেতে পারে।

এ প্রসঙ্গে নগর পরিকল্পনাবিদ ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, আমাদের দেশে যেভাবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করা হয়, তাতে মনে হয় বর্জ্য থেকে খুব সহজে করোনা ভাইরাস নিম্নশ্রেণীর মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়তে পারে। তিনি বলেন, নারায়ণগঞ্জে করোনা ভাইরাস ভয়াবহ রূপ ধারণ করার পেছনে অনেক কারণের মধ্যে বর্জ্য বা নোংরা পরিবেশও অনেকাংশে দায়ী বলে মনে করা হচ্ছে। এজন্য এ বিষয়ে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা ::

প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসে আক্রান্তদের চিকিৎসা করার সময় ব্যবহৃত ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী (পিপিই) ও মাস্কসহ চিকিৎসা সরঞ্জামের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বিশেষ উদ্যোগ নেয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ১২ এপ্রিল গণভবন থেকে খুলনা ও বরিশাল বিভাগের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হয়ে তিনি এই নির্দেশনা দেন।

শেখ হাসিনা বলেন, কোভিড-১৯ এর চিকিৎসায় ব্যবহৃত পিপিই, মাস্ক বা যেসব চিকিৎসা সরঞ্জাম ব্যবহার করা হয়, সেগুলো জীবাণুমুক্ত রাখা এবং এই বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য বিশেষ পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রশাসনের সকল কর্মকর্তা, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যারা কর্মরত আছেন তারা এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা নেবে। যাতে এটা থেকে কোনোরকম করোনার প্রাদুর্ভাব না ছড়ায়। সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *