স্বাস্থ্য

করোনা টিকার ‘বুস্টার ডোজ’ কি সবাই পাবেন?

নিজস্ব প্রতিবেদক, ধূমকেতু ডটকম: করোনার প্রতিষেধক হিসেবে দুই ডোজ টিকাই যথেষ্ট, নাকি বুস্টার ডোজ হিসেবে তৃতীয় ডোজ দেওয়া জরুরি, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যেই বিতর্ক চলছে। বিশ্বজুড়ে টিকার ক্রমবর্ধমান চাহিদার বিপরীতে কিছু উন্নত দেশ তাদের নাগরিকদের জন্য বুস্টার ডোজ দেওয়ার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে। এ অবস্থায় বিষয়টির সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টিকার বুস্টার ডোজ কতটা প্রয়োজন, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। দরিদ্র দেশগুলোয় টিকার সংকট মিটিয়ে তারপর তৃতীয় ডোজের বিষয়টি ভাবা উচিত। তৃতীয় ডোজের অর্থ এটা না যে, সবাই বাড়তি ডোজ পাবে বা সবার এটার প্রয়োজন রয়েছে। বিশ্ব স্বা্স্থ্য সংস্থা এবং বার্তা সংস্থা এএফপি, সিএনবিসি, এনডিটিভি, বিবিসি ও সিএনএন সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। 

করোনাভাইরাসের ভয়াবহতার সঙ্গে বাড়ছে টিকার চাহিদা। উন্নত বিশ্বের অনেক দেশই তাদের বেশির ভাগ মানুষকে টিকার আওতায় এনেছে। আবার অনেক দেশই টিকাদানে বহু পিছিয়ে রয়েছে। এর মধ্যেই আলোচনা চলছে টিকার তৃতীয় ডোজ বা বুস্টার ডোজ নিয়ে। বুস্টার ডোজ নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।  বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টিকার বুস্টার ডোজ কতটা প্রয়োজন, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। অনেকেই বলছেন, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয় টিকার সংকট মিটিয়ে তারপর তৃতীয় ডোজের বিষয়টি ভাবা উচিত। এসব বিতর্কের মধ্যেই অনেক দেশ বুস্টার ডোজ দিতে শুরু করেছে বা শুরু করার কথা ভাবছে। 

বার্তা সংস্থা এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি মাসের শুরুর দিকে করোনার টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ফাইজার–বায়োএনটেক টিকার বুস্টার ডোজের বিষয়টি সামনে আনে। বাড়তি ডোজের ফলে ভাইরাসটির বিরুদ্ধে সুরক্ষা আরও শক্তিশালী হবে বলে দাবি করে তারা। টিকা উৎপাদনকারী এই প্রতিষ্ঠানের মতে, টিকার দুই ডোজ নিলে শরীরে কমপক্ষে ছয় মাস অ্যান্টিবডি থাকে। মার্কিন ও ইউরোপের কর্তৃপক্ষের কাছে তারা তৃতীয় ডোজের অনুমোদন চাইবে।

যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ অ্যান্থনি ফাউসি সম্প্রতি সংবাদমাধ্যম সিএনবিসিকে বলেন, ফাইজার–বায়োএনটেকের তৃতীয় ডোজের জন্য আবেদন বুস্টার ডোজের সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলেছে। তবে এর অর্থ এটা না যে সবাই বাড়তি ডোজ পাবে বা সবার এটার প্রয়োজন রয়েছে। কারণ, এখনো অনেক মানুষ রয়েছেন, যাঁরা দুটি ডোজ পাননি।  টিকার তৃতীয় ডোজ আদতেই প্রয়োজন আছে কি না, তা শিগগিরই বলা যাবে না বলে উল্লেখ করেছে ইউরোপিয়ার মেডিসিনস এজেন্সি এবং ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল। যৌথ এক বিবৃতিতে তারা জানায়, করোনার দুই ডোজ টিকা কত দিন পর্যন্ত সুরক্ষা দেয়, তা জানতে যথেষ্ট তথ্য চলমান টিকা কার্যক্রম এবং নানা পরীক্ষা–নিরিক্ষা থেকে এখনো পাওয়া যায়নি। একই মত দিয়েছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) জরুরি কমিটির পরিচালক দিদিয়ের হউসিন।

এদিকে সম্প্রতি হাঙ্গেরির প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ওবান বলেন, দেশটিতে আগস্ট থেকে টিকার তৃতীয় ডোজ দেওয়া শুরু হবে। ইউরোপের এই দেশের বাসিন্দাদের চীন ও রাশিয়ার টিকা দেওয়া হচ্ছে। যদিও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) শুধু মডার্না, ফাইজার-বায়োএনটেক, অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার অনুমোদন দিয়েছে।  এর মধ্যেই বেশ কয়েকটি দেশ টিকার তৃতীয় ডোজ দিতে শুরু করেছে। বুস্টার ডোজ দিতে শুরু করেছে ফ্রান্স ও ইসরায়েল। সাধারণত যাঁদের শরীরে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম, যাঁদের অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা হয়েছে এবং যাঁরা ক্যানসার বা কিডনির সমস্যায় ভুগছেন, তাঁদের টিকার তৃতীয় ডোজ দেওয়া হচ্ছে। এমন ব্যক্তিদের টিকার দুই ডোজ দেওয়া পরও শরীরে কম অ্যান্টিবডি উৎপন্ন হয়। ফলে তৃতীয় ডোজের প্রয়োজন পড়ে।  চলতি বছরের শুরুতেই টিকা নেওয়া শেষ করেছেন, এমন ব্যক্তিদের সেপ্টেম্বর থেকে বুস্টার ডোজ দেওয়া হবে বলে  জানিয়েছে ফ্রান্স।

চলতি মাসের শুরুর দিকে দেশটির ভ্যাকসিন কাউন্সিল জানায়, ৮০ বছরের বেশি বয়সের লোকজনদের টিকার বুস্টার ডোজ দেওয়া শুরু হবে। মহামারির ধরন বুঝে সম্ভাব্য তরুণদেরও তৃতীয় ডোজ দেওয়া হতে পারে বলে জানিয়েছে ভ্যাকসিন কাউন্সিল। 

দুই ডোজ টিকা দেয়ার পরও লাখ লাখ ব্রিটেনবাসীকে বুস্টার ডোজ হিসেবে করোনার তৃতীয় ডোজ দেয়ার প্রস্তুতি শুরু করেছে যুক্তরাজ্য। বয়স্ক ও দুর্বল নাগরিকদের এই ডোজের আওতায় আনা হবে। শীতের আগে করোনার নতুন ধরনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ শক্তি বাড়ানোর উদ্দেশ্যে এই পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। দেশটির বিভিন্ন গণমাধ্যমের বরাতে এই খবর দিয়েছে এনডিটিভি। 

ব্রিটিশ সংবাদ সংস্থা বিবিসি জানিয়েছে, যুক্তরাজ্যের জাতীয় স্বাস্থ্য সার্ভিস (এনএইচএস) করোনার টিকা দানের এই বর্ধিত কর্মসূচির ব্যাপারে সবুজ সংকেত দিয়েছে। স্বাস্থ্য এবং সামাজিক তত্ত্বাবধান মন্ত্রী সাজিদ জাভিদ বলেছেন, সেপ্টেম্বর থেকে এই বর্ধিত টিকাদান কর্মসূচি শুরু করার জন্য এনএইচএস-এর সঙ্গে কাজ শুরু করেছেন। তিনি বলেন, আমাদের প্রথম টিকাদান কর্মসূচি দেশে স্বস্তি এনেছে। তৃতীয় টিকাদান কার্যক্রমের মাধ্যমে সেটাকে সুরক্ষিত করা হবে। 

এক্সপ্রেস নিউজ পেপার স্বাস্থ্যবিভাগের বরাত দিয়ে জানিয়েছে, জয়েন্ট কমিটি অব ভ্যাকসিনেশন অ্যান্ড ইমিউনিসেশন-এর (জেসিভিআই) পরামর্শ অনুযায়ী বার্ষিক টিকাদান কর্মসূচির পাশাপাশি এই কার্যক্রম চলবে। ভ্যাকসিন বিষয়ক মন্ত্রী নাদিম জাহাবি বলেন, করোনার টিকাদান কর্মসূচিতে আমরা ব্যাপক সাফল্য পেয়েছি। ৮৫ শতাংশ বয়স্ক মানুষ প্রথম ডোজের টিকা পেয়েছেন। উভয় ডোজ পাওয়া লোকের সংখ্যা ৬২ শতাংশ। এই সাফল্য ধরে রাখতে আমরা এখন আমাদের ‌দুর্বল প্রতিরোধ শক্তির বয়সী মানুষদের বুস্টার ডোজ দেয়ার কর্মসূচি শুরু করতে যাচ্ছি। শীত শুরু হওয়ার আগেই এটা শেষ করব আমরা। 

ভ্যাকসিন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ব্রিটেনে এ ধরনের তিন কোটি নাগরিক রয়েছেন, যাদের তৃতীয় ডোজ টিকার জন্য বিবেচনা করা যেতে পারে। এদের মধ্যে পঞ্চাশোর্ধ্ব সবাইকে এবং এর চেয়ে কমবয়সী দুর্বল প্রতিরোধ শক্তির নাগরিকদের চিহ্নিত করে এই টিকা দেয়া হবে বলে মন্ত্রী জানান।  বুস্টার ডোজে কোন ধরনের টিকা ব্যবহার করা হবে অবশ্য তা উল্লেখ করা হয়নি।

এদিকে, ভ্যাকসিনকে আরও শক্তিশালী করতে এবং করোনাভাইরাসের বিভিন্ন ভ্যারিয়েন্ট থেকে সুরক্ষা দিতে একটি বুস্টার ডোজ আবিষ্কারের জন্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছে ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ফাইজার। সিএনএন জানায়, সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটি এ নিয়ে একটি বিবৃতি দিয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ভ্যাকসিনের তৃতীয় ডোজ কতটা কার্যকর হবে সেই বিষয়ে আরও তথ্য প্রকাশের পর আগস্ট মাসে জরুরী ভিত্তিতে ব্যবহারের জন্য তারা মার্কিন খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসনের কাছে বুস্টার ডোজের জন্য অনুমোদন চাইবে। 

এদিকে ফাইজার বিবৃতি দেওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর যুক্তরাষ্ট্রের দুটি শীর্ষ ফেডারেল এজেন্সি, এফডিএ এবং রোগ ও নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র জানিয়েছে, সম্পূর্ণ ডোজ টিকা দেওয়া আমেরিকানদের এই মুহূর্তে  বুস্টার ডোজের প্রয়োজন নেই এবং সেটি কখন তাদের প্রয়োজন হতে পারে এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা এককভাবে সংস্থাগুলোর হাতে নেই।  ফাইজার এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ‘ইসরায়েলের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় প্রকাশিত বাস্তব তথ্যে দেখা গেছে, সংক্রমণ এবং লক্ষণজনিত রোগ উভয় প্রতিরোধে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা ছয় মাসের পর কমেছে, যদিও গুরুতর রোগীদের ক্ষেত্রে এর কার্যকারিতা বেশি। সর্বোচ্চ মাত্রার সুরক্ষা বজায় রাখতে দ্বিতীয় ডোজের ছয় থেকে ১২ মাসের মধ্যে তৃতীয় ডোজ উপকারী হতে পারে। তবে মার্কিন প্রশাসনের কর্মকর্তারা জোর দিয়ে বলেছেন যে, সম্পূর্ণ ডোজ টিকা নেওয়া ব্যক্তিদের সংক্রমণের ঝুঁকি কম থাকে, এমনকি তুলনামূলক বেশি সংক্রামক ডেল্টা বা বি.১.৬১৭.২ ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধেও কম ঝুঁকি থাকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *