স্বাস্থ্য

করোনার এই সময়ে মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার গুরুত্ব

ডঃ বিজয়
যদি জীবনকে সুন্দর করতে চাও, তবে স্বাস্থ্যসম্মত অভ্যেসগুলোকে নিষ্ঠার সাথে পালন করো – মার্গারেট ফুলার।

স্বাস্থ্য-এর অনেক সংজ্ঞা রয়েছে। WHO কতৃক ১৯৪৮ সালে ঘোষিত সংজ্ঞা অনুযায়ী,

“স্বাস্থ্য বলতে সম্পূর্ণ শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক কল্যাণবোধকে বোঝায়। শুধু রোগ বা দুর্বলতার অনুপস্থিতিকেই স্বাস্থ্য বলেনা।”

আবার, ১৯৮৬ সালে WHO-এর স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সংজ্ঞা:

“স্বাস্থ্য দৈনন্দিন জীবনের একটি সম্পদ, এটা বেঁচে থাকার কোনো উদ্দেশ্য নয়। সামাজিক ও ব্যক্তিগত জীবনে স্বাস্থ্য একটি ইতিবাচক ধারণা যা শারীরিক ক্ষমতা অর্জনে উদ্বুদ্ধ করে।”

এর অর্থ হলো, একটি বৃহত্তর সমাজে একজন ব্যক্তির অবস্থান অনেকাংশেই তার স্বাস্থ্যের উপর নির্ভরশীল। একজন অসুস্থ মানুষের অনেক অর্থ-সম্পদ থাকলেও সমাজে তার মূল্য অনেক নিচে নেমে আসে। একটি পরিপূর্ণ জীবনের জন্য একটি স্বাস্থ্যকর জীবনধারা খুবই প্রয়োজনীয়।

সাধারণত স্বাস্থ্য বলতে শারীরিক মানসিক স্বাস্থ্যকেই বোঝায়। কিন্তু মানুষের এই দুই ধরনের স্বাস্থ্যকে টিকিয়ে রাখার জন্য আধ্যাত্মিক নিরাময়, আর্থিক সচ্ছলতা, আবেগ নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এখন আমরা জানব মানসিক স্বাস্থ্য বলতে কী বোঝায়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংজ্ঞা অনুযায়ী, একজন ব্যক্তি মানসিকভাবে তখনই ভাল থাকেন যখন তিনি তাঁর কর্মদক্ষতা বুঝতে পারেন, জীবনের স্বাভাবিক চাপের সঙ্গে বুঝতে পারেন, ফলপ্রসূ কাজ করতে পারেন এবং তাঁর সম্প্রদায়ের জন্য কিছু অবদান রাখতে পারেন।

মানসিক স্বাস্থ্য বলতে একজন মানুষের আবেগিক, সামাজিক এবং মানসিক সুস্থতাকে বোঝায়। একজন মানুষের পরিপূর্ণ এবং সক্রিয়ভাবে জীবন-যাপনের জন্য শারীরিক সুস্থতার পাশাপাশি মানসিক সুস্থতাও প্রয়োজন। বিশ্বে প্রতি চার জন মানুষের মধ্যে ১ জন মানসিক অসুস্থতায় ভোগেন। WHO-এর পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০১৯ সালে বিশ্বজুড়ে প্রায় ৪৫ কোটি মানুষ মানসিক অসুস্থতার শিকার। যার জেরে প্রতি ৪০ সেকেন্ডে বিশ্বজুড়ে ১ জন আত্মহত্যা করে । আত্মহত্যাজনিত মৃত্যুর অধিকাংশই প্রতিরোধযোগ্য। অধিকাংশ ব্যক্তিই আত্মহত্যার সময় কোনো না কোনো মানসিক রোগে আক্রান্ত থাকেন। সাধারণত সেটা গুরুত্ব দেওয়া হয় না বা মানসিক রোগ নিশ্চিত হলেও যথাযথ চিকিৎসা করা হয় না বলেই আত্মহত্যার মত ঘটনা দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নের মাধ্যমে আত্মহত্যার হার কমিয়ে আনা সম্ভব বলে মত ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের।

করোনাভাইরাসকালীন কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সবাইকে মেনে চলতে হবেঃ

১। ইতিবাচক চিন্তা করুন।

২। পর্যাপ্ত ঘুম, সুষম খাদ্য গ্রহণ করুন এবং নিয়মিত ব্যায়াম করুন ।

৩। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ও ধ্যান (meditation) করুন। ধর্মের বিধি বিধানের চর্চা করুন।

৪। নিয়মিত রুটিন মেনে চলুন এবং বই পড়ুন ।

৫। আপনার পরিবারের সাথে Quality সময় ব্যয় করুন।

৬। আমরা Fun করবো এবং কারো সাথে দ্বন্দ্বে জড়াব

না।

৭। শিশু ও বয়স্কদের প্রতি মনোযোগী হবো : পরিবার এবং শিশুদের সাথে সময় ব্যয় করুন। স্পষ্ট এবং অ্যাক্সেসযোগ্য ভাষায় ঘটনাটি ব্যাখ্যা করুন; রুটিনটি বজায় রাখার চেষ্টা করুন। শিশুদের যে কোনও প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য প্রস্তুত থাকুন।এই সময়ে শিশুরা আরও বেশি খিটখিটে, সংবেদনশীল হতে পারে। এই আচরণগুলির জন্য তাদের দোষ না দেয়া গুরুত্বপূর্ণ । এক ধরনের এবং আশ্বাসপ্রাপ্ত পদ্ধতির ব্যবহার করুন। তাদের বিরক্তিকর অনুভূতি যেমন ভয়, ইতিবাচক উপায়ে প্রকাশ করতে শেখান। তারা যে পরিমাণ তথ্যের সংস্পর্শে আসে তা নিয়ন্ত্রণ করুন যাতে তারা আরও ভীতু না হয় ।

ইমিউনোপ্রেসড, বয়স্ক এবং সাইকিয়াট্রিক রোগীদের সাথে আচরণ: এই জনগোষ্ঠীকে রোগ-জীবাণুর সংস্পর্শ থেকে রক্ষা করতে সহায়তা করুন – বিশেষত সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ; ফোন / ভিডিও কল এবং সামাজিক নেটওয়ার্কগুলির মাধ্যমে তাদের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিন। ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে (যেমন, সুপারমার্কেটে কেনাকাটা করা) এমন কার্যগুলিতে তাদেরকে সহায়তা করা উচিত। তাদের যে কোনো লক্ষণ সম্পর্কে বৃহত্তর নজরদারি বজায় রাখুন এবং তারা যখন একা থাকেন তখন প্রতিটি সম্ভাব্য আরামের গ্যারান্টি দিন। তাদের ক্লিনিকাল এবং মানসিক রোগের ওষুধের নিয়মগুলি মেনে চলা এবং সংবেদনশীল সহায়তা প্রদানে সচেষ্ট হউন।

৯। আপনার মানবীয় গুণাবলীগুলো জাগিয়ে তুলুন।

১০। WHO (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা) এবং সরকারী স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুসরণ করুন ।

১১। সংবেদনশীল দূরত্ব এড়িয়ে গিয়ে অন্য ব্যক্তির সাথে তিন মিটার দূরত্ব বজায় রাখুন ।

১২। আপনার মানসিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করুন ।

১৩। মহামারী COVID-19 সংক্রান্ত খবর জানার বিষয়টি সীমাবদ্ধ করুন, যেহেতু অত্যধিক তথ্য উদ্বেগজনিত অসুস্থতাগুলিকে বাড়াতে পারে ।

১৪। যখন আপনি দুঃখ বা উদ্বেগের লক্ষণ অনুভব করেন তখন কাউকে বলুন।

১৫। যতটা সম্ভব ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠীর লোকদের সহায়তা করুন।

১৬। অজানা পরিস্থিতিতে মানসিক চাপ এবং ভয় প্রত্যাখ্যান বা অসহায়ত্বের সাথে একাকীত্ব এর বিভ্রান্তিকে এড়িয়ে চলুন।

১৭। আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলুন । একটি ভাল নেটওয়ার্ক স্থাপন করুন (এটি ভার্চুয়াল হলেও)।

করোনাভাইরাসকালীন বর্জনীয় কর্মকাণ্ড:

১। ধূমপান এবং মাদকদ্রব্য পরিহার করুন।

২। অতিরিক্ত ফাস্ট ফুড খাওয়া হতে বিরত থাকুন।

৩। অতিরিক্ত অনলাইন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করবেন না।

৪। অতিরিক্ত করোনা সংক্রান্ত খবর টিভিতে দেখবেন না।

৫। ভ্রমণ হতে বিরত থাকুন।

৬। করোনা সংক্রান্ত ভুল তথ্য এবং সংবাদে বিশ্বাস করবেন না।

করোনাভাইরাসকালীন আরও ব্যক্তিগত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হবেঃ

১. গণপরিবহন এড়িয়ে চলা কিংবা সতর্কতার বিষয়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বাস, ট্রেন কিংবা অন্য যে কোনো ধরণের পরিবহনের হাতল কিংবা আসনে করোনাভাইরাস থাকতে পারে। সেজন্য যে কোনো পরিবহনে চলাফেরার ক্ষেত্রে অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করা এবং সেখান থেকে নেমে ভালোভাবে হাত পরিষ্কার করা।

২. অফিসে একই ডেস্ক এবং কম্পিউটার ব্যবহার করলেও ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাঁচি-কাশি থেকে করোনাভাইরাস ছড়ায়। যে কোনো জায়গায় করোনাভাইরাস কয়েক ঘন্টা এমনকি কয়েকদিন পর্যন্ত সক্রিয় থাকতে পারে। অফিসের ডেস্কে বসার আগে কম্পিউটার, কিবোর্ড এবং মাউস পরিষ্কার করে নিন।

৩. যেসব জায়গায় মানুষ বেশি জড়ো হয় সে সব স্থান এড়িয়ে চলা কিংবা বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করুন। তিন মিটার দূরত্ব বজায় রাখুন। এর মধ্যে খেলাধুলার স্থান, সিনেমা হল থেকে শুরু করে ধর্মীয় স্থানও রয়েছে।

৪. বাংলাদেশে বিভিন্ন ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানে যখন গ্রাহকরা যান তখন অনেকেই একটি কলম ব্যবহার করেন। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কোনো ব্যক্তি যদি সে কলম ব্যবহার করেন তাহলে পরবর্তী ব্যবহারকারীদেরও করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে। সে জন্য নিজের কলম আলাদা করে রাখতে পারেন। এতে সংক্রমণের ঝুঁকি কমবে। এছাড়া টাকা উত্তোলনের জন্য যে এটিএম বুথ ব্যবহার করা হয়, সেখান থেকেও সংক্রমণ হতে পারে। কারণ এটিএম বুথের বাটন অনেকে ব্যবহার করে।

৫. ভাইরাস সংক্রমণের ক্ষেত্রে আরেকটি জায়গা হতে পারে বাড়ি কিংবা অফিসের লিফট। লিফট ব্যবহারের সময় নির্ধারিত ফ্লোরে যাবার জন্য লিফটের বাটন অনেকে ব্যবহার করছেন। বিভিন্ন অফিস ভবনে প্রতিদিন শত-শত মানুষ লিফট ব্যবহার করছেন। এদের মধ্যে কেউ যদি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী থাকেন এবং সে লিফটের বাটনে অন্যদের আঙ্গুল গেলেও সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকে।

আমাদের জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বস্তু হচ্ছে আমাদের স্বাস্থ্য। এই স্বাস্থ্যকে রক্ষা করা এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে একটা সুখী জীবনযাপন করাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত।

কবির ভাষায় বলতে চাই – “তুমি নির্মল কর মঙ্গল কর, মলিন মর্ম মুছায়ে। তব, পূণ্য-কিরণ দিয়ে যাক মোর, মোহ-কালিমা ঘুচায়ে। মলিন মর্ম মুছায়ে”।

  • ডঃ বিজয়, জনস্বাস্থ্য গবেষক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *