নিখিল মানখিন, ধূমকেতু বাংলা: দেশে অ্যান্টিবডি টেস্ট শুরু করা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে নানা যুক্তি উপস্থাপন করে যাচ্ছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের ঘোষণা দেয়ার পরও শুরু হয়নি অ্যান্টিবডি টেস্ট। বিশ্বের শতাধিক দেশে দ্রুত সংক্রামক করোনা ভাইরাস ‘ওমিক্রন’ এর বিস্তার লাভের পর অ্যান্টিবডি টেস্ট শুরু করার বিষয়টি আবার আলোচনায় উঠে এসেছে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলছেন, শরীরকে সুস্থ রাখতে দিন-রাত প্রহরায় আছে অ্যান্টিবডি। অ্যান্টিজেন ঢুকলে সে সজাগ হয়ে মোকাবিলা করতে শুরু করে দেয়। ফলে কোনও ওষুধ ছাড়াই প্রতি মূহুর্তে অজস্র ভাইরাস, ব্যাকটিরিয়াকে পরাজিত করতে পারি আমরা। করোনা টিকা গ্রহণের ছয় মাস পরই হ্রাস পেতে থাকে অ্যান্ডিবডি। কে করোনা ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত তা জানা, যা রোগীর পৃথকীকরণের (আইসোলেশন) প্রথম ধাপ হিসেবে কাজ করে। আর এই পৃথকীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে অ্যান্টিবডি টেস্ট।
গবেষণায় দেখা গেছে, করোনাভাইরাসে সংক্রামিত হলেও অনেকের শরীরে অসুস্থতার কোনো হালকা লক্ষণ না-ও দেখা যেতে পারে। ফলে তারা নিজের অজান্তেই রোগ ছড়াতে পারে। তাই এ ক্ষেত্রে অ্যান্টিবডি টেস্ট এসব রোগীকে (যাদের রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়নি) শনাক্ত করতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। এ ছাড়া এই পরীক্ষার ফলাফল ডাক্তারকে রোগীর পরবর্তী চিকিৎসা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করতে পারে। আর বহুল আলোচিত কনভ্যালসেন্টস প্লাজমা থেরাপির জন্য অ্যান্টিবডি টেস্ট অত্যন্ত জরুরি।
কোভিড-১৯কে উদাহরণ হিসেবে নিয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলছেন, করোনার স্পাইক প্রোটিন শরীরে ঢুকলে শরীরও অ্যান্টি-স্পাইক প্রোটিন তৈরি করতে শুরু করে দেয়। অ্যান্টিজেনের প্রবেশের পরে শরীর যখন অ্যান্টিবডি তৈরি করে, তখন তাকে বলে অ্যাক্টিভ ইমিউনিটি। যখন শরীর অ্যান্টিবডি তৈরি করতে পারে না, তখন বাইরে থেকে ভ্যাকসিনের মাধ্যমে সরাসরি অ্যান্টিবডি দেওয়া হয়। একে বলে প্যাসিভ ইমিউনিটি। মায়ের গর্ভে শিশুও মায়ের শরীর থেকে অ্যান্টিবডি গ্রহণ করে। সে ক্ষেত্রেও কিন্তু এটি প্যাসিভ ইমিউনিটি। আমাদের দেহের ইমিউনতন্ত্র জীবাণু থেকে ভ্যাকসিনের তফাত করতে পারে না। তাই ভ্যাকসিন প্রয়োগের ফলে আমাদের দেহ আক্রান্ত ব্যক্তির ন্যায়ই অ্যান্টিবডি তৈরি করতে পারে। ভ্যাকসিন প্রয়োগে অ্যান্টিবডি প্রাপ্তির সুবিধে হল, তাকে আক্রান্ত হয়ে রোগভোগ করতে হল না বলে জানান বিশেষজ্ঞরা।
গত ২০ ডিসেম্বর রাজধানীতে করোনার বুস্টার ডোজ উদ্বোধন শেষে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা সাংবাদিকদের বলেন, করোনা টিকা দেয়ার পর অ্যান্টিবডি সব সময় ঠিক থাকে না। টিকা নেয়ার ছয় মাস পরই হ্রাস পেতে থাকে অ্যান্টিবডি বলে জানান ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা।
প্রখ্যাত অণুজীব বিজ্ঞানী ও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র উদ্ভাবিত কিটের (অ্যান্টিজেন ও অ্যান্টিবডি) গবেষক দলের প্রধান বিজ্ঞানী ড. বিজন কুমার শীল সাংবাদিকদের বলেন, করোনা চলে গেলে অ্যান্টিজেনের দরকার নেই, পিসিআরের দরকার নেই। কিন্তু রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দেখার জন্য কাকে ভ্যাকসিন দিতে হবে এবং ভ্যাকসিন দেয়ার পর তার মধ্যে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে কি না -এগুলো করতে হলে অ্যান্টিবডি টেস্ট লাগবে।
তিনি আরও বলেন, ভ্যাকসিন নেয়ার মানে এই নয় সবার অ্যান্টিবডি এসেছে। কার অ্যান্টিবডি এলো, কার এলো না -সেটা যাচাই করতে অ্যান্টিবডি কিটের কোনো বিকল্প নেই।
অ্যান্টিবডি ও অ্যান্টিবডি টেস্ট সম্পর্কে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডাঃ আশরাফুল হক বলেন, শরীরে যখন কোনও জীবাণু ঢুকে তখন শরীরের বিরুদ্ধে কাজ শুরু করে। সেটিকে নষ্ট করার জন্য যেটি তৈরি হয় তার নাম অ্যান্টিবডি। প্রথম যে অ্যান্টিবডি তৈরি হয় তার নাম ‘আইজিএম’। করোনার ক্ষেত্রে সেটি রক্তে পাওয়া যায় ৭ম দিন থেকে। এরপর আসে আইজিএম, যা মূলত শরীরের বাকি প্রতিরক্ষার কাজ করে। পিসিআর দিয়ে কেউ আক্রান্ত কিনা বুঝা যায় আর অ্যান্টিবডি দিয়ে বুঝা যায় আক্রান্ত হওয়ার পর তিনি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়েছেন কিনা। আর একবার ক্ষমতা তৈরি হলে সাধারণত তিনি আরেকজনের জন্য ক্ষতির কারণ হন না। তাই অ্যান্টিবডি টেস্ট করা হলে দেশের সার্বিক করোনা পরিস্থিতির চিত্র বেরিয়ে আসবে বলে মনে করেন ডাঃ আশরাফুল হক।
অ্যান্টিজেন ও অ্যান্টিবডি:
সম্প্রতি একটি আন্তর্জাতিক জার্নালে কলকাতার মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. অরুণাংশু তালুকদার বলেন, অ্যান্টিজেনকে ফরেন প্রোটিন বা নন-সেল্ফ প্রোটিন বলা যেতে পারে। আগে বুঝতে হবে, কোনগুলো সেল্ফ আর কোনগুলো নন-সেল্ফ। মেডিসিনের চিকিৎসক অরুণাংশু তালুকদার বললেন, শরীরে হাড়ের প্রোটিন, চামড়ার প্রোটিন সবই আলাদা। সন্তান যখন মায়ের গর্ভে থাকে, তখন থেকেই তার শরীর চিনতে শুরু করে কোনটা তার নিজের আর কোনটা নয়। এবার নিজের শরীরের বাইরের প্রোটিন (সে হতে পারে ভাইরাস, ব্যাকটিরিয়া, প্যারাসাইটস) শরীরে প্রবেশ করলেই শরীর রিঅ্যাক্ট করে। কারণ সেটা তো নন-সেল্ফ প্রোটিন। শরীর তাকে চেনে না। এই প্রোটিনকেই শরীর অ্যান্টিজেন হিসেবে গণ্য করে। ভাইরাস নিজে থেকে কিন্তু মাল্টিপ্লাই হতে পারে না। হোস্ট অর্থাৎ আক্রান্তের শরীরের বাইরে সে বংশবিস্তার করতে পারে না।
জেনারেল ফিজ়িশিয়ান ডা. সুবীর কুমার মণ্ডল বললেন, ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করার পরে ওর জেনেটিক মেটিরিয়াল আমাদের কোষে ঢুকিয়ে দেয়। তার পর আমাদের কোষের প্রোটিন তৈরির মেশিনারি কাজে লাগিয়ে ও নিজস্ব কপি তৈরি করতে শুরু করে। এটাই ভাইরাসের জীবনচক্র। এই ভাইরাসের প্রোটিনকে শরীর অ্যান্টিজেন হিসেবে গণ্য করে। করোনার যেমন স্পাইক প্রোটিন।
অ্যান্টিবডি সম্পর্কে ডা. অরুণাংশু তালুকদার বলেন, অ্যান্টিজেনকে ধ্বংস করার জন্য পাঁচ রকমের প্রোটিন আমাদের শরীরে তৈরি হয়ে থাকে। এদের বলা হয় ইমিউনোগ্লোবিউলিনস (আইজি), যাকে এক কথায় অ্যান্টিবডি বলা হয়। প্রত্যেক দিনই একাধিক ভাইরাস, ব্যাকটিরিয়ার সংস্পর্শে আমরা আসি। এই ইমিউনোগ্লোবিউলিনস তাদের প্রতিরোধ করে। এটি আবার পাঁচ ভাগে বিভক্ত, আইজিএ, আইজিডি, আইজিই, আইজিজি এবং আইজিএম। আমাদের শরীরে কোনও অ্যান্টিজেন প্রবেশ করলেই শরীর সতর্ক হয়ে যায়। তখন সেই অ্যান্টিজেন ধ্বংস করতে প্রথমেই যে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, তাকে বলে আইজিএম। কিন্তু তার আয়ু কম। তাই সেটা কপি করে অন্য একটি অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, যাকে বলে আইজিজি। এই প্রোটিন কিন্তু অনেক দিন ধরে শরীরে সেই অ্যান্টিজেনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এবার আমাদের শরীরের চোখ, নাক, শ্বাসনালীর মতো অংশে অর্থাৎ যেখানে সিক্রেশন হয়, সেখানে আর একটি অ্যান্টিবডি থাকে, আইজিএ। শরীরকে চার দিক থেকে কিন্তু এই ইমিউনোগ্লোবিউলিনস পাহারা দিয়ে রাখে। এ ছাড়া আরও দু’টি অ্যান্টিবডি থাকে আইজিই ও আইজিডি। কোনও কিছু থেকে অ্যালার্জি হলে বা পোকায় কামড়ালে দেখবেন সে জায়গাটা ফুলে লাল হয়ে যায়। যেমন, মশা কামড়ালে সেখানটা লাল হয়ে যায়। কারণ মশার লালারস থেকেও অ্যান্টিজেন প্রবেশ করে। তখন সেখানে যে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে তাকে বাধা দেয়, এটি হল আইজিই। আইজিডি অন্যান্য আইজির কার্যকারিতায় সাহায্য করে।
আরো পড়ুন:
সুরক্ষা অ্যাপ হালনাগাদের পরে সারাদেশে বুস্টার ডোজ শুরু হবে: স্বাস্থ্যমন্ত্রী