মুক্তাশা দীনা চৌধুরী
ইংরেজি ২০২০ খৃষ্টাব্দ। ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনায় নতুন বছরের শুরু। কেউ জানতো না কী আসছে এ বছর জুড়ে। প্রথমে চীন তারপর এক এক করে বিভিন্ন দেশ পেরিয়ে মার্চ মাসে বাংলাদেশে প্রথম শনাক্ত হল করোনা রোগী। আজ পর্যন্ত প্রায় ছয় লাখের বেশি বাংলাদেশী এ রোগে আক্রান্ত। মৃত্যুবরণ করেছে ছয় হাজারের উপর। গত দু’ মাস প্রাদুর্ভাব একটু কম হলেও ইতিমধ্যেই বিশ্বজুড়ে শুরু হয়েছে এর দ্বিতীয় ঢেউ। বাংলাদেশেও একই অবস্থা। মার্চের ১৭ তারিখ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে সরকার। এরপর ২৬ তারিখ থেকে শুরু হয় লকডাউন। প্রায় স্থবির হয়ে পড়ে শিক্ষা কার্যক্রম। এমতাবস্থায় অনলাইন প্ল্যাটফর্ম যেন শিক্ষাক্ষেত্রে এক নতুন দ্বার উন্মোচন করে।
অনলাইন শিক্ষা প্রচলিত পদ্ধতি থেকে পৃথক। তাই শিক্ষকেরা নতুন করে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করে ঠিক করেন শিক্ষাদানে কী বিষয় অন্তর্ভুক্ত বা কী অন্তর্ভুক্ত করবেন না। সেভাবে চিন্তা করলে বলা যায় পাঠদানের গুণগত মান বৃদ্ধিই পেয়েছে। শিক্ষকদের অনলাইনে পাঠদানের জন্য কোর্সের গ্লোবাল স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী পুনরায় ডিজাইন করতে হয়, যা তাকে নতুনভাবে ক্লাস নিতে অনুপ্রেরণা দেয়।
অনলাইন শিক্ষা এমন একটি প্ল্যাটফর্ম, যেখানে শিক্ষকরা ভিডিও লেকচার শিট এবং পিপিটি তৈরি করেন, যাতে শিক্ষার্থীরা কোর্সের বিষয় একাধিকবার দেখতে বা বিশ্লেষণের সুযোগ পেয়ে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা জুম এর মাধ্যমে ক্লাস নেয়া শুরু করেন এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের সকল ক্লাসের রেকর্ড সংরক্ষিত থাকে যেখান থেকে দেখা যায় ক্লাসের সংখ্যা এবং ছাত্রছাত্রী উপস্থিতি অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রযুক্তি-চালিত বিশ্বে কিভাবে অনলাইন এবং শ্রেণিকক্ষে উভয় ক্ষেত্রে শিক্ষা গ্রহণ করবে সে সম্পর্কে এই পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা নতুন ধারণা লাভ করেন।
প্রথম দিকে যদিও নতুন এ পদ্ধতি আয়ত্ত করতে শিক্ষক বা ছাত্রছাত্রীদের অনেক বেগ পেতে হয়েছে, কিছুদিনের মধ্যেই এ পদ্ধতি যেন সবার প্রিয় হয়ে উঠেছে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষকদের এ পদ্ধতিতে পাঠদানে দক্ষ করে তোলা হয়েছে। এ পদ্ধতিতে পড়াশোনার ব্যয়ও অনেকাংশে কমে গিয়েছে বলে মনে করেন ছাত্রছাত্রীরা। কারণ সবাই বাসা থেকে ক্লাস করতে পারছেন। অভিভাবকদের মানসিক উদ্বেগ অনেকটা কম, সন্তানতো চোখের সামনেই আছে। অনলাইন ব্যবস্থা চালু থাকলে চাকুরীজীবী অনেকেই মাস্টার্স প্রোগ্রাম বা এমবিএ প্রোগ্রামে ভর্তি হবার কথা ভাবছেন। তারা ভাবছেন যদি ক্যাম্পাসে যেতে না হয় তবে তারা চাকুরী করেও অনলাইনে পড়াশুনা চালিয়ে যেতে পারবেন।
তবে এ পদ্ধতির কিছু সীমাবদ্ধতাও আছে বলে মনে করেন শিক্ষকেরা। এর মধ্যে অন্যতম হলো পরীক্ষা পদ্ধতি। সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ করা এখানে খুব কঠিন। শিক্ষার্থীরা নকল করলেও তা বোঝা কষ্টসাধ্য। এক্ষেত্রে শ্রেণীকক্ষে পরীক্ষার বিকল্প নেই। করোনাকালীন এবং এর পরবর্তী শিক্ষাব্যবস্থার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় অনলাইন পাঠদান এবং শ্রেণীকক্ষে পরীক্ষা গ্রহণ এই সমন্বয় বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার হার বাড়িয়ে দেবে বলে ধারণা অনেক শিক্ষাবিদদের। যা কিনা ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনে নতুন মাইলফলক হবে বলে আশা করা যায়।
অনলাইন পদ্ধতির আরেকটি সমস্যা ইন্টারনেট। হঠাৎ ক্লাসে বা পরীক্ষার সময় নেট চলে যাওয়ার ঘটনাও কম নয়। অনলাইন পদ্ধতিতে ক্যাম্পাস জীবনের অনেকটাই ছাত্রছাত্রীরা উপভোগ করতে পারেন না, যে জীবন বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশীর ভাগ ছাত্রছাত্রীদের অনেক কাঙ্ক্ষিত।
এতো কিছুর মাঝেও করোনা পরিস্থিতিতে অনলাইন শিক্ষা পদ্ধতি সত্যি যেন আশীর্বাদ হয়ে এসেছে সবার জীবনে। শিক্ষাপদ্ধতি যেমনি হোক, করোনার হাত থেকে মুক্তি পাক গোটা বিশ্ব। প্রাণ ফিরে পাক মানব জাতি।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক (পরিসংখ্যান), এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।