নিখিল মানখিন, ধূমকেতু বাংলা: রাজধানীর জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসককে দেখিয়ে বাইরে বের হয়ে আসছেন মো. নাসির উদ্দিন (৪৩)। তার হাতে চিকিৎসকের দেয়া প্রেসক্রিপশন। প্রেসক্রিপশন দেখেই দৌঁড়ে এলেন কয়েকজন লোক। কিছু না বলেই রোগীর প্রেসক্রিপশনে হাত দিলেন তাদের একজন। অনুমতি না নিয়ে হাত দেয়ায় রেগে গেলেন মো. নাসির উদ্দিন। এবার তারা নিজেদেরকে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি (রিপ্রেজেন্টেটিভ) বলে পরিচয় দিলেন। প্রতিবাদী মুখের সংখ্যা বেড়ে গেলে অন্যত্র সরে গেলেন তারা।
শুধু এই হাসপাতালেই নয়, দেশের প্রতিটি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে চলে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের দৌরাত্ম। রোগী ও এই প্রতিনিধিদের মধ্যে কথা কাটাকাটি, মারামারিসহ নানা অনাকাঙ্কিত ঘটনা যেন স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে রোগীর ব্যক্তিগত গোপনীয়তার বিষয়টি লঙ্ঘিত হচ্ছে।
নগরীর শেরে বাংলা নগরের জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানেও (পঙ্গু হাসপাতাল) ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের দৌরাত্ম্য লক্ষ করা গেছে। চিকিৎসকের কক্ষের দরজায় লেখা সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত কোনও ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধির দেখা করার নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা মানা হয় না। রোগীরা বের হলেই ব্যবস্থাপত্র নিয়ে করা হচ্ছে টানাহেচড়া।
হার্ট অ্যাটাকের রোগী মো. ফয়সাল (৫১)। ইমার্জেন্সি বিভাগে দেখিয়ে তাকে ভর্তি করাতে ব্যস্ত ছেলে জমির উদ্দিন। তিনি ট্রলিম্যানের পেছনে হাতে চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন নিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। দৌড়ে গিয়ে ওষুধ কোম্পানির এক প্রতিনিধি প্রেসক্রিপশন দেখানোর আবদার জানালেন। সময় না থাকার কথা জানিয়ে এড়িয়ে গেলেন জমির উদ্দিন। তারপরও হাল ছাড়ে না প্রতিনিধি। কিন্তু জমির উদ্দিনের চোখ রাঙানোতে ফিসফিস করে সরে গেলেন ওই প্রতিনিধি। হাসপাতালের ওয়ার্ড মাস্টার আবুল কালাম জানান, নিষেধাজ্ঞা দেয়ার পরও প্রতিনিধিদের ভিড় লেগেই থাকে। রোগী ও তাদের অভিভাবকদের প্রায় সময় বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়। তাদের সামাল দিতে বাড়তি নিরাপত্তাকর্মীও রাখা হয়েছে বলে জানান আবুল কালাম।
পঙ্গু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. আবদুল গনি মোল্লা ধূমকেতু বাংলাকে বলেন, ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের প্রবেশ করার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। প্রয়োজনে দুপুরের পর অনুমতি নিয়ে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের সঙ্গে দেখা করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। নির্দেশনা ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে বলে জানান অধ্যাপক ডা. আবদুল গনি মোল্লা।
এদিকে, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওষুধ কোম্পানি প্রতিনিধিদের কয়েকজন ধূমকেতু বাংলাকে বলেন, কোন চিকিৎসক কোন কোম্পানির ওষুধ ব্যবস্থাপত্রে লিখেন তা জানতে আমরা রোগীদের প্রেসক্রিপশন দেখানোর অনুরোধ করে থাকি। জোর করে প্রেসক্রিপশন দেখার অভিযোগ অস্বীকার করেন তারা। তারা আরও জানান, প্রেসক্রিপশনে তাদের কোম্পানির ওষুধ লিখার জন্য প্রতিমাসেই কলম, পেড, চাবির রিং থেকে শুরু করে টিভি-ফ্রিজসহ মোটা অংকের উপহার দেন তারা ডাক্তারদের। বিনিময়ে প্রেসক্রিপশনে আমাদের ওষুধ লেখার গোপন চুক্তি থাকে। এছাড়া এসব ব্যবস্থাপত্রের একটি কপি মেইল করে হেড অফিসেও পাঠাতে হচ্ছে বলে জানান ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা।
কল্পনা আক্তার নামের এক রোগী বলেন, আমি বেশি অসুস্থ হওয়ার পর বাধ্য হয়ে চিকিৎসকের কক্ষের সামনে গিয়ে দাঁড়াই। সেখানে দেখি ওই চিকিৎসকের সঙ্গে কেউ বসে, কেউ দাঁড়িয়ে খোশগল্পে মেতে রয়েছেন বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা। দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর বাধ্য হয়ে দরজা ঠেলে কক্ষে ঢুকে চিকিৎসকের কাছ থেকে চিকিৎসা গ্রহণ করি।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্সস ও হাসপাতালে ২৮ নভেম্বর দুপুরে সরেজমিনে গেলে দেখা গেছে, হাসপাতালের সামনে এবং ভেতরে বিভিন্ন চিকিৎসকের কক্ষের সামনে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের ভিড় লেগেই আছে। নির্দিষ্ট সময়ের বাইরে তারা ভিজিট করে রোগীদের চিকিৎসাসেবায় ব্যাঘাত ঘটাচ্ছেন। ভবনটির নীচতলায় আবাসিক চিকিৎসক ও আশেপাশের কয়েকটি কক্ষের সামনে প্রতিনিধিদের অবাধ বিচরণ যেন একটু বেশি। সম্মতি নিয়ে কয়েকজন রোগীর প্রেসক্রিপশন দেখতেও প্রতিনিধিদেরকে দেখা গেছে। দরিদ্র ও সহজ-সরল রোগী ও তাদের অভিভাবকদেরকে প্রতিনিধিরা বেশি টার্গেট করে। প্রেসক্রিপশন দেখানোর ক্ষেত্রে এ ধরনের লোকজনের কাছ থেকে প্রতিনিধিরা বেশি বাধার সম্মুখীন হয় না। লক্ষ করা গেছে, চিকিৎসকদের কক্ষের সামনে রোগীদের বসার জন্য সাজানো সিটে প্রতিনিধিদের কেউ কেউ বসে থাকনে। চিকিৎসকের কক্ষ থেকে বের হলেই রোগীর পেছনে ছুটতে শুরু করেন তারা। প্যাথলজিসহ বিভিন্ন মেডিকেল পরীক্ষাগারের সামনেও তারা ঘুরাফেরা করেন। একটি ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি মো. হাশেম ধূমকেতু বাংলাকে বলেন, চিকিৎসা সেক্টরে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের অনেক গুরুত্ব রয়েছে। বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির আবিষ্কৃত নতুন নতুন ওষুধের বিষয়ে বিভিন্ন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও চিকিৎসকদেরকে অবহিত করার দায়িত্ব পালন করেন প্রতিনিধিরা। তারা ওষুধের বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেন যাতে চিকিৎসকরা তা যাচাই করার পর রোগীদের ব্যবস্থাপত্রে লিখে দেন।
এখানে কথা হয় গুলশানের নদ্দা এলাকার সুফিয়া বেগমের সাথে। তিনি বলেন, মাথা ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে এসেছিলাম। ডাক্তারের কাছ থেকে বের হওয়ার সাথে সাথেই কয়েকজন লোক আমার প্রেসক্রিপশন নিয়ে মোবাইলে ছবি তোলা শুরু করলো। আমি এমনিতেই রোগী মানুষ, তাতে আবার হয়রানি। তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন সুফিয়া বেগম।
আরো পড়ুন: