স্বাস্থ্য

ওমিক্রন রোধে নির্দেশনাগুলোর বাস্তবায়ন জোরালো করতে হবে : জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞগণ

নিখিল মানখিন, ধূমকেতু বাংলা: করোনাভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন নিয়ে শঙ্কায় পুরো বিশ্ব। বিভিন্ন  দেশ  জরুরি অবস্থাসহ নানান প্রতিরোধ ব্যবস্থা ঘোষণা করে যাচ্ছে। বাংলাদেশে ওমিক্রন প্রতিরোধে ইতোমধ্যে ঘোষিত নির্দেশনাসমূহ কাগজে-কলমেই রয়ে গেছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, নির্দেশনা ঘোষণা করে বসে থাকলেই হবে না, সেগুলো মাঠে বাস্তবায়ন করে দেখাতে হবে। দেশের সর্বত্র করোনাময় পরিবেশ বিরাজ করছে। স্বাস্থ্যবিধি মানার চিত্র হারিয়ে যাচ্ছে। দেশে ইতোমধ্যে ওমিক্রন শনাক্ত হয়েছে। আমরা যদি আগের মতো পরিস্থিতি অপ্রস্তুতভাবে সামলাতে থাকি তাহলে বাংলাদেশ যে সামনে কঠিন যাত্রার মুখে পড়বে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নতুন ভ্যারিয়েন্টটি প্রায় ৬০ দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। বিজ্ঞানীদের মতে, ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের তুলনায় ওমিক্রন প্রাথমিক পর্যায়ে ৪ দশমিক ২ গুণ বেশি সংক্রামক। এর মানে হলো-এটি অনেক সহজে ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং আরও রূপান্তরিত হলে এটি আরও বেশি সংক্রামক হয়ে উঠতে পারে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের ১৫টি নির্দেশনা:

করোনাভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্ট ‘ওমিক্রন’ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। ওমিক্রন ঠেকাতে বাংলাদেশে অধিকতর সতর্কতার অংশ হিসেবে ১৫টি নির্দেশনা জারি করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ ও লাইন পরিচালক মো. নাজমুল ইসলামের সই করা বিজ্ঞপ্তিতে এসব নির্দেশনার কথা বলা হয়েছে।  নির্দেশনায় বলা হয়েছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ওমিক্রন সম্পর্কে সতর্ক করেছে। এ কারণে দক্ষিণ আফ্রিকা, নামিবিয়া, জিম্বাবুয়ে, বতসোয়ানা, এসওয়াতিনি ও লেসোথোর সঙ্গে আকাশপথে যোগাযোগ বন্ধ করেছে যুক্তরাজ্যসহ কিছু দেশ।   করোনাভাইরাসের নতুন এই ভেরিয়েন্ট ডেলটার চেয়েও বেশি সংক্রামক বলে বিশেষজ্ঞরা মত প্রকাশ করেছেন।  এ ভাইরাস দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা আছে। ওমিক্রন বিষয়ে অধিকতর সতর্কতার অংশ হিসেবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জারি করা ১৫ নির্দেশনা হলো- দক্ষিণ আফ্রিকা, নামিবিয়া, জিম্বাবুয়ে, বতসোয়ানা, এসওয়াতিনি, লেসোথো এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আরও যেসব আক্রান্ত দেশের নাম ঘোষণা করবে, বিমানবন্দরে সেসব দেশ থেকে আসা যাত্রীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও স্ক্রিনিং জোরদার করতে হবে।  সব ধরনের সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও অন্যান্য জনসমাগম নিরুৎসাহিত করতে হবে। বাড়ির বাইরে যেতে হলে প্রত্যেককে সব সময় সঠিকভাবে নাক-মুখ ঢেকে মাস্ক পরাসহ সব স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।  হোটেল-রেস্তোরাঁয় ধারণক্ষমতার অর্ধেক বা তার কম মানুষের খাবার ব্যবস্থা করতে হবে। সব ধরনের জনসমাবেশ, পর্যটন স্থান, বিনোদন কেন্দ্র, রিসোর্ট, কমিউনিটি সেন্টার, সিনেমা হল, থিয়েটার হল ও সামাজিক অনুষ্ঠান যেমন: বিয়ে, জন্মদিন, পিকনিক, পার্টি ইত্যাদিতে ধারণক্ষমতার অর্ধেক বা তার কমসংখ্যক লোক অংশ নিতে হবে। মসজিদসহ সব উপাসনালয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নিশ্চিত করতে হবে। গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে হবে। আক্রান্ত দেশগুলো থেকে আগত যাত্রীদের ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইন বাধ্যতামূলক করতে হবে। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে (মাদ্রাসা, প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, বিশ্ববিদ্যালয় ও কোচিং সেন্টার) স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে হবে। সব স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে সেবাগ্রহীতা, সেবা প্রদানকারী ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সব সময় সঠিকভাবে নাক-মুখ ঢেকে মাস্ক পরাসহ সব স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নিশ্চিত করতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে টিকা কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। করোনা উপসর্গলক্ষণযুক্ত সন্দেহজনক ও নিশ্চিত করোনা রোগীর আইসোলেশন ও করোনা পজিটিভ রোগীর সংস্পর্শে আসা অন্যান্যদের কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।  কোডিড-১৯ এর লক্ষণযুক্ত ব্যক্তিকে আইসোলেশনে রাখা এবং তার নমুনা পরীক্ষার জন্য স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে সহায়তা করা যেতে পারে। অফিসে প্রবেশ এবং অবস্থানকালে বাধ্যতামূলকভাবে নাক-মুখ ঢেকে মাস্ক পরা নিশ্চিত করতে হবে।  স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা দাফতরিকভাবে নিশ্চিত করতে হবে। কোডিড-১৯ রোগ নিয়ন্ত্রণ ও হ্রাস করার নিমিত্তে কমিউনিটি পর্যায়ে মাস্ক পরাসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার সচেতনতা তৈরির জন্য মাইকিং ও প্রচারণা চালানো যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনে মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডার মাইক ব্যবহার করা যেতে পারে এবং ওয়ার্ড কাউন্সিলর, ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যসহ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করা যেতে পারে বলে নির্দেশনা দিয়েছে স্বাস্থ্য  অধিদফতর।

মাঠে সরকারি নির্দেশনাসমূহের বাস্তবায়ন নেই:

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ওমিক্রন প্রতিরোধে স্বাস্থ্য অধিদফতর  ঘোষিত নির্দেশনাসমূহের কোনো বাস্তবায়ন  দেখা যায়নি। নেই মনিটরিং অবস্থা। ঘোষণা দিয়েই যেন দায়িত্ব শেষ অধিদফতর এবং সংশ্লিষ্টদের। সরেজমিন ঘুরে দেখা  গেছে, দেশের মানুষ যেন করোনা ভাইরাসের ভয়াবহতা ভুলে যেতে বসেছে। সর্বত্র চলছে স্বাস্থ্যবিধি অমান্য করার প্রতিযোগিতা। পূর্ণাঙ্গ স্বাস্থ্যবিধি তো দূরের কথা, মুখে মাস্ক ব্যবহারকারীর সংখ্যাও দ্রুত কমে যাচ্ছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ নিয়ে হাসি ঠাট্টায় মেতে উঠছে অনেকে। স্বাস্থ্যবিধি মানতে পরামর্শদানকারীর উপর চড়াও হওয়ার ঘটনাও ঘটছে।

নির্দেশনাসমূহ অমান্য করে সব ধরনের সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও অন্যান্য জনসমাগম রয়েই গেছে। অফিসে প্রবেশ এবং অবস্থানকালে বাধ্যতামূলকভাবে নাক-মুখ ঢেকে মাস্ক পরার বিষয়টি কার্যকর হচ্ছে না। কোডিড-১৯ রোগ নিয়ন্ত্রণ ও হ্রাস করার নিমিত্তে কমিউনিটি পর্যায়ে মাস্ক পরাসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার সচেতনতা তৈরির জন্য মাইকিং ও প্রচারণা চালানোর চিত্র চোখে পড়ে না। সর্বত্রই চলে  অপ্রয়োজনীয় আড্ডা। চা দোকানগুলোতে ভিড় লেগেই থাকে। গণ পরিবহনে নেয়া হয় অতিরিক্ত যাত্রী। সব  মিলিয়ে ওমিক্রন  প্রতিরোধ  সরকারি নির্দেশনাসমূহের বাস্তবাস্তবায়ন চিত্র চোখে পড়েনি।

নির্দেশনাসমূহ মেনে চলতে হবে:

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের(আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুস্তাক হোসেন ধূমকেতু বাংলাকে বলেন, করোনা মহামারির শুরুর দিকে দেশ লকডাউনে যেতে বাধ্য হওয়ায় যে ব্যাপক অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছিল, তা আমরা এখনো পুষিয়ে উঠতে পারিনি। এর মানে ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টটি স্পষ্টভাবেই আমাদের নাগরিকদের স্বাস্থ্যসহ অর্থনীতির জন্য ঝুঁকি তৈরি করেছে।  আমরা যদি আগের মতো পরিস্থিতি অপ্রস্তুতভাবে সামলাতে থাকি তাহলে বাংলাদেশ যে সামনে কঠিন যাত্রার মুখে পড়বে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।  আশা করি, কর্তৃপক্ষ আগে যে ভুলগুলো করেছিল তা থেকে শিক্ষা নিয়েছে। আকস্মিক কঠোর ব্যবস্থার পরিবর্তে শুরু থেকেই সরকারকে দেশে নতুন ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়া রোধে সক্রিয় হতে হবে।  বিমানবন্দরে বা অন্য যেকোনো জায়গায় বা যেসব পয়েন্টে মানুষ বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারে সেখানে কঠোর নজরদারি ও স্ক্রিনিং নিশ্চিত করতে হবে।  যারা দেশে প্রবেশ করবেন তাদের ন্যূনতম ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করতে হবে।  বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ অনুযায়ী, কোভিড-১৯’র প্রতিটি নতুন কেসের জিনোমিক সিকোয়েন্সিং করা উচিত যাতে ওমিক্রনের সংক্রমণ সীমিত করা যায়। সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে যে হাসপাতালে হঠাৎ করে রোগী বেড়ে গেলে তারা যেন তা মোকাবিলায় প্রস্তুত থাকে। হাসপাতালে স্বাস্থ্য নির্দেশিকা কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে।

বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব ধূমকেতু বাংলাকে বলেন, ওমিক্রনকে উপেক্ষা করা যায় না। শনাক্তকরণের অনেক মাস পর ডেল্টা ভেরিয়েন্টে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ওমিক্রন শনাক্ত হওয়ার পর মাত্র দুই সপ্তাহ কেটে গেছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত কার্যকর না হওয়ায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক বলে মনে করছেন জনগণ। মানুষের মনে এক ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ আস্থা তৈরি হয়েছে। ফলে দেশে এখনও করোনা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কা রয়েছে।

আরো পড়ুন:

ওমিক্রন নিয়ে সতর্ক থাকার নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *