আন্তর্জাতিক

এরদোগানের বক্তব্যের পর সুর নরম করল তালেবান

তুরস্কের কাবুল বিমান বন্দরের দায়িত্ব নেয়ার বিষয়ে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে তালেবানের কাছ থেকে হুমকি ধামকি আসছিল। এই হুমকি এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে তালেবান তুরস্ককে ‘দখলদার’ বলতে পর্যন্ত দ্বিধা করেনি। আর তুরস্ক যদি আফগানিস্তানে সৈন্য রাখে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ চালানোরও ইঙ্গিত দেয় তালেবান। এমনকি আলোচনার টেবিল থেকে এক তরফাভাবে উঠে যাওয়ার অভিযোগও তুলে তুরস্কের বিরুদ্ধে।

তুরস্ক এতদিন সুর নরম করেই তালেবানের এই সব অভিযোগ এবং দাবির উত্তর দিয়েছে। কিন্তু তুরস্ক যত নরম হয় তালেবানের সুর তত গরম হয়। এবং শেষ পর্যন্ত তুরস্ককে “দখলদার” বলে আখ্যায়িত করে। যা আসলে অনেক তুর্কিই ভালোভাবে নেয়নি।

এবার তালেবানের এই সব অভিযোগের জবাব আসে তুরস্কের একেবারে উচ্চ পর্যায় থেকে।

এরদোগান এবার তালেবানকে সংযত হবার আহ্বান জানান। তিনি তালেবানের সঙ্গে বৈঠকে বসার ইঙ্গিত দিয়েছেন ঠিকই কিন্তু তালেবানের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডকেও একটু কূটনৈতিক ভাষায় স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছেন, তালেবানের সঙ্গে তুরস্কের ধর্মীয় বিশ্বাসে কোনো বিভেদ, দ্বন্দ্ব, সংঘাত বা সমস্যা নেই। একই ধর্মীয় বিশ্বাস ধারণ করে । তাই তুরস্কের সঙ্গে তালেবানের সমঝোতায় আসা সহজ।

অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, তুরস্কের বিরুদ্ধে বিবৃতি দেয়ার ক্ষেত্রে তালেবানের উচিত আরও সংযত হওয়া এবং সাবধানতা অবলম্বন করা। কারণ তুরস্কের মত গুরুত্বপূর্ণ একটা সুন্নি মুসলিম দেশের সঙ্গে উত্তেজনা বাড়িয়ে কারো লাভ নেই। যে তালেবান চীন, রাশিয়া, ইরান এবং ভারতের সঙ্গে বৈঠক করতে পারে, তাদের অনেক অনৈতিক শর্ত মেনে নিতে পারে, সেই তালেবানের আসলেই তুরস্কের সঙ্গে আরও সংযত আচরণ করা উচিত।

তালেবানের হুশিয়ারির বিরুদ্ধে এরদোগান বলেন, ‘তুরস্ক কাবুল বিমানবন্দর নিয়ে যে পরিকল্পনা করেছে সে বিষয়টি তালেবান খুব ভালোভাবেই জানে’।

অর্থাৎ এ বিষয়ে তালেবানকে আগেই অভিহিত করা হয়েছে এবং তুরস্কের আসল পরিকল্পনা তালেবানকে জানানো হয়েছে।

এই পরিকল্পনা আসলে আমরা গণমধ্যমের সংবাদে যা দেখছি বা জানছি তার চেয়েও বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ কিছু। কিন্তু আমার কাছে মনে হয় তালেবান হয়ত সে পরিকল্পনার দ্রুত বাস্তবায়ন চায় অথবা পরিকল্পনা মেনে নিতে গড়িমসি করছে । তাই তুরস্কের কাবুল বিমানবন্দরে থাকার ঘোর বিরোধিতা অব্যাহত রাখছে এবং নিজেদের দাবি পূরণ না হওয়ায় পর্দার অন্তরালের আলোচনা এখনও ফলপ্রসূ হয়নি।

তালেবান এখানে তুরস্ককে আলোচনার টেবিল ছেড়ে উঠার জন্য অভিযুক্ত করে। কিন্তু তুরস্ক তালেবানকে এবার আরও বড় কয়েকটি বিষয়ে অভিযুক্ত করে।

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান বলেন, ‘আফগানিস্তান এমন একটি দেশ যার ৯৯ ভাগ মানুষ মুসলমান। সেখানে তালেবান তার মুসলমান ভাইয়ের ভূমি জোর করে দখল করছে। তালেবানের এই দখলের নীতি পরিহার করা উচিত। বিশ্বকে দেখানো উচিত যে, আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠা আফগানদের দ্বারাই সম্ভব এবং ভাইয়ে ভাইয়ে মিলে থাকা উচিত।’

এখানে তিনি আসলে উত্তরাঞ্চলীয় তুর্কি জাতিগোষ্ঠীদের এলাকা দখলের প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছেন।

তুরস্কের বিরুদ্ধে তালেবানের বিবৃতির কথাও উল্লেখ করেন তিনি; যেখানে তালেবান তুরস্কের বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ এনেছে। এরদোগান এক্ষেত্রে তালেবানকে সরাসরি আক্রমণ না করে কৌশলের অবলম্বন করেন। আর বলেন যে, তাদের বিবৃতিতে তালেবান ‘তুরস্ককে চাচ্ছে না’ বলে কোনো কথা নেই।

তবে তিনি জানান যে, তুরস্ক কাবুল বিমানবন্দরের দায়িত্ব নেয়ার যে কথা বলেছে সেখানে তুরস্কের রাষ্ট্র হিসেবে কিছু পরিকল্পনা আছে এবং তালেবান সেগুলো জানে।

একে অপরের দিকে এই অভিযোগের তীর ছুড়াকে অনেকে ভবিষ্যৎ সংঘাতের ইঙ্গিত হিসেবে দেখছেন। কিন্তু আমার মনে হয়, এগুলো আসলে আলোচনার টেবিলে বসার আগে যে যার ওপর যতটুকু সম্ভব চাপ সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে।

আমার মনে হয় এখানে এরদোগানের বার্তা হলো- আমেরিকা বা ন্যাটোর সঙ্গে চুক্তির বাইরেও তুরস্কের রাষ্ট্র হিসেবে কাবুল বিমানবন্দর নিয়ে ভিন্ন কিছু পরিকল্পনা করছে এবং সেটি তালেবানকে নিয়েই বা তালেবানকে জানিয়ে তাদের ইতিবাচক ইঙ্গিত নিয়েই করছে। তবে তালেবান হয়তো সবকিছু দ্রুত চাচ্ছে। অর্থাৎ তুরস্কের সেই পরিকল্পনার দ্রুত বাস্তবায়ন চাচ্ছে কিন্তু তুরস্ক আস্তে আস্তে এগুচ্ছে।

এরদোগান বলেন, আমাদের সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ গ্রহণ করছি। তিনি তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং রাষ্ট্রপতির কারযলয় থেকে এ নিয়ে তালেবানের সঙ্গে যোগাযোগ চলছে। বিশেষ করে কাতারের উপর দিয়ে তালেবানের সঙ্গে বৈঠক চলছে।

আর সবকিছু পরিকল্পনা মাফিক গেলে এরদোগান তালেবানের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করবেন। তবে তুরস্কের প্রতি তালেবানের মনোভাবের পরিবর্তন করতে হবে।

কারণ যে তালেবান, চীনের মত এক অপ্রতিরোধ্য ড্রাগন, রাশিয়ার মত এক হিংস্র ভাল্লুক, ভারতের মত বন্য হাতি ইরানের মত একটা কট্টর শিয়া রাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের স্বার্থের জন্য বৈঠকে বসতে পারে। সেই তালেবানের তুরস্কের মত একটা সুন্নি মুসলিম অধ্যুষিত দেশের সঙ্গে আরও খোলামেলা ভাবেই আলোচনায় বসা উচিত।

আর আফগানিস্তানের কাবুল বিমানবন্দরের নিরাপত্তার দায়িত্ব নেয়ার ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনার জন্য তুরস্ক তালেবানের সঙ্গে বৈঠক করবে বলে জানান দেশটির রাষ্ট্রপতি রিসেপ তাইয়্যিপ এরদোগান। তালেবানের সঙ্গে একটা সমঝোতায় পৌছার জন্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন বলেও ইঙ্গিত দেন।

আরেকটি বিষয় তুরস্কের কাবুল বিমানবন্দরে থাকা বা আফগানিস্তানে তুরস্কের সেনাবাহিনী থাকা ভবিষ্যৎ আফগানিস্তানের স্থিতিশীলতা এবং শান্তির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সে ক্ষেত্রে শর্তগুলো কি হবে তা নির্দিষ্ট করা জরুরি। তবে তুরস্ককে ওখানে দখলদারি রাষ্ট্র হিসেবে মূল্যায়ন করা তালেবানের জন্য বড় একটা ভূল ছিল।

এবং আমার মনে হয় এরদোগান তার বিবৃতিতে আসলে তালেবানের সেই ভুলটাকে একটু স্মরণ করিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছেন। তবে এক্ষেত্রেও ভাষার ব্যবহার ছিল লক্ষণীয়।

এখনও পর্যন্ত যে ইঙ্গিত আসছে তাতে তুরস্ক আফগানিস্তান ছাড়বে বলে মনে হয় না। আর তালেবানও তুরস্ককে খুব সহজে মেনে নিবে বলে মনে হয় না। তবে শেষ পর্যন্ত তালেবান মেনে নিতে পারে বলে আমার মনে হয়।

এরদোগানের এই বার্তার সারমর্ম হলোঃ তালেবান তুমি জানো আমি ওখানে কী করতে চাচ্ছি। এবং তোমার কাছে আমাদের এই বিষয়গুলো অনেকটাই স্পষ্ট করা হোয়েছে। তুমি যেমন কৌশলগত কারণে এখন চীন রাশিয়া ভারত এবং ইরানের সঙ্গে চুক্তি কোরছো। তোমার আদর্শের এবং মতধারার সম্পূর্ণ বিপরীত হওয়ার পরেও হিকমতের দোহাই দিয়ে তাদের সঙ্গে চুক্তি কোরছো এবং অনেক ধরণের অবান্তর প্রতিশ্রুতি দিচ্ছো। আমারও তেমনি ন্যাটো এবং আমেরিকার সঙ্গে কৌশলগত কারণে কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছি। এবং এগুলো তোমাদেরকে আগেই বলা হয়েছে।

কিন্তু তারপরও তোমরা তুরস্কের বিরুদ্ধে যে ভাষা ব্যবহার করেছো সে ভাষা কোনো ভাবেই কূটনৈতিক শিষ্টাচারে পরে না। তুমি তুরস্ককে দখলদার বোলছো অথচ তুরস্ক সেখানে কোন দখলদারি টেন্ডেন্সি নেই। অথচ তুমি ৯০ ভাগ মুসলমান অধ্যুষিত একটা দেশে বিভিন্ন অঞ্চল দখল করেই চলছো। কার ভূমি কে দখল কোরছে? মুসলমান ভাইয়ের ভূমি দখল করার নীতি পরিহার করা উচিত।

আমেরিকা এবং ন্যাটো চলে যাচ্ছে। এটা একটা ভালো সুযোগ। এই সুযোগে আফগানিস্তানে শান্তির জন্য কাজ করা দরকার। সারা বিশ্বকে দেখানো দরকার যে আফগানিরাই পারে আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠা কোরতে।

সুতরাং আসও আমরা বৈঠকে বসি। তুমি যেমন বৈঠকে বসার ইচ্ছা পোষণ করেছো আমিও বৈঠকে বসতে চাচ্ছি। তুমি অন্যসব কম্যুনিস্ট, হিন্দু এবং শিয়া রাষ্ট্রের সঙ্গে তুমি বসতে পারলে, লিয়াজ করতে পারলে তুরস্কের সঙ্গে বসতে তোমাদের এতো অনীহা কেন? সবেমাত্র ক্ষমতায় বসতে যাচ্ছো আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে খুব জাঁদরেল খেলোয়াড় না হলে তুমি দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না।

সুতরাং আসও আক্রমণাত্মক ভঙ্গি পরিহার করে গঠনমূলক আলোচনায় লিপ্ত হই এবং শান্তিপূর্ণ একটা সমাধনে আসার চেষ্টা করি।

তুরস্কের প্রতি সুর নরম করে যা বলছে তালেবান

এরদোগানের ওই বার্তার পর তালেবান সুর নরম করতে শুরু করেছে। তালেবানের মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদিন তুরস্কের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন টিআরটি আরাবিয়ায় এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমরা তুরস্কের সঙ্গে সুসম্পর্ক চাই, তুরস্ক আমাদের ভাই। ধর্ম বিশ্বাসের ভিত্তিতে আমাদের অনেকগুলি কমন বিষয় রয়েছে। আমরা চাই তুরস্ক অতীত ছেড়ে বর্তমান এবং ভবিষ্যতের দিকে ফিরে আসুক। তার পরে আমরা সংলাপের জন্য বসতে পারি।

তালেবানের এই বার্তা দলটির তুর্কি নীতিতে অনেকটা নমনীয় হওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *