তথ্য, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

এমি অ্যাওয়ার্ডপ্রাপ্ত রুবাইয়াত ও তার দলকে শুভেচ্ছা

ওয়াহিদ ইবনে রেজা :


উন্মাদ অফিসে তিনজন পাগল এসেছে, উচ্চশিক্ষিত পাগল। তিনজনই বুয়েটে পড়ে, একজন মেকানিক্যালে, দুইজন কম্পিউটারে। উন্মাদে অবশ্য উচ্চশিক্ষিত পাগলের সংখ্যা কম না। উন্মাদে সাধারণত সবসময় বেশ কিছু ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার থাকে। ডাক্তাররা সংখ্যায় একটু বেশি থাকে। হাবিব ভাই এর ভাষ্যমতে, ডাক্তাররা প্রচুর নোটপ্যাড পায় দেখে লেখালেখি/আঁকাআঁকিরও অনুপ্রেরণা পায় প্রচুর। ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজেও বুয়েটের উচ্চশিক্ষিত (!) পাগল দেখে আমার উপর দায়িত্ব পড়লো এদের সাথে কথা বলার। এরা তিনজনই আমার দুই ব্যাচ জুনিয়র। আমি আবার এদের একজনকে চিনি, মেকানিক্যালের জাহিদ। মেক্যানিক্যাল ফেস্টিভ্যাল এর যাবতীয় ব্যাকড্রপ বানানোর দায়িত্বে সে সাধারণত সবচেয়ে সামনে থাকে। অনুষ্ঠানের আগে সারারাত কাজ করে ঘুমিয়ে পড়ে স্টেজের উপর!
আমি খুবই বিরস গলায় জাহিদকে বললাম, এই তোরা এখানে কী করতাসিস? তোদের ক্লাসফ্লাস নাই?
জাহিদ চরম উত্তেজিত হয়ে বললো, বাপ্পি ভাই একটা কমিক্স বানাবো! আপনারা ব্যবস্থা করে দেন।
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। উন্মাদ অফিসে মুখ দিয়ে কেউ কমিক্স শব্দটা উচ্চারণ করেছে আর সেটা বাস্তবায়ন করা হয় নাই এমন রেকর্ড বিরল। হাবিব ভাই প্রায় জাহিদের মত চরম উৎসাহে কমিক্স বের করার ব্যবস্থা করে দিলেন। উন্মাদের কার্টুনিস্ট মেহেদির উপর দায়িত্ব থাকলো সমন্বয় করা, মতান্তরে এই পাগলদের লাইনে রাখা। জাহিদের অন্য দুজন বন্ধুর সাথেও পরিচয় হলো। একজনের নাম জি এম তানিম, অন্যজন রুবাইয়াত হাবীব। তানিম যতটা কথা বলতে পছন্দ করে, রুবাইয়াত ততটাই চুপচাপ। তানিমের নামের জি এম দিয়ে কি কি হতে পারে এই নিয়ে গবেষণা করার পাশাপাশি ওদের কমিক্সের কাজ চললো। কমিক্সের নাম, ভাক্ষস!
বইমেলায় বের হবার পর তো সেই কমিক্স ইতিহাস। শেষ কপিটা যতদূর মনে হয় বৃষ্টিতে ভিজে যাবার পরও বিক্রি হয়ে যায়! এরপর তানিম বেশ কিছুদিন আইডিয়া দেয় উন্মাদে। জাহিদ ও রুবাইয়াত কিছুদিন কার্টুন আঁকে। তারপর আর কি, বুয়েটের চাপে তাপে ওদের আসা কমে যায় উন্মাদ অফিসে। পরে যে যার মত উচ্চশিক্ষা নিতে চলে যায় বাইরে। ওদের ক্রিয়েটিভ কাজ খুব বেশি আর করা হয়ে ওঠে না। অনন্ত আমি তাই ভাবতাম।
রুবাইয়াত এর সাথে এরপর আমার যখন দেখা হয় তখন সে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ সিঙ্গাপুর থেকে পিএইচডি শেষ করেছে। আমি ওকে বললাম, আঁকাআঁকি কি তাহলে বন্ধ?
সে খুবই অমায়িকভাবে বললো, না ভাইয়া, এনিমেশনের সফটওয়্যারই বানাচ্ছি।
এবার আমার অবাক হবার পালা। ও আমাকে পিএইচডি’র জন্য করা স্যান্ড এনিমেশনের কাজ দেখায়। আমি মুগ্ধ হই, মুগ্ধ হই, মুগ্ধ হই! কী সুন্দর, কী সুন্দর! প্রতিভার কী চমৎকার ব্যবহার।
এরপর থেকে প্রায়ই রুবাইয়াত এর সাথে আমার যোগাযোগ হয়। একেক বার ওর সাথে কথা বলি আর ইন্সপায়ার্ড হই। আমি ভবিষ্যৎবাণী করি, বাংলাদেশ থেকে নাফিস ভাই এর পর যে অস্কার পুরস্কারটা নিয়ে আসবে, সে হবে আমাদের রুবাইয়াত। রুবাইয়াত অবশ্য এই কথা শুনে বিনয়ের সাথে বলে, ভাইয়া কি যে বলেন, কি যে বলেন।
অস্কার আপাতত না পেলেও রুবাইয়াত এর চমৎকার কাজ কিন্তু চলতে থাকে। ওর পিএইচডি থিসিস থেকে ডেভেলপ করা এপ্লিকেশন Sketchbook Motion বেস্ট iPad app এর অ্যাওয়ার্ড পায়। এবং তার ধারাবাহিকতায় ও কিছুদিন আগে জানায় যে এ বছর এমি অ্যাওয়ার্ড এর জন্য ওদের টিম নমিনেশন পেয়েছে! আমি খুশিতে লাফ দিয়ে উঠে বললাম, রুবাইয়াত, তোমার এই কথা তো সবাইকে জানানোর দরকার! সংবাদপত্রে ছাপা হওয়া দরকার। রুবাইয়াত তার স্বভাব সুলভ নরম গলায় বললো, ভাইয়া নিউজ হলে খারাপ হয় না। জানেন আমাদের অনেকে কিন্তু প্রোগ্রামিং এর অনেক ফিল্ডে খুব উচ্চ পর্যায়ে কাজ করে। কিন্তু কেন জানি এই ক্রিয়েটিভ ফিল্ডে তেমন বাংলাদেশী প্রোগ্রামার দেখা যায় না। মানুষের আসলে জানা উচিত যে এরকম করে প্যাশন আর প্রফেশন এক করা সম্ভব।
আমি বললাম, অবশ্যই সম্ভব! দাঁড়াও তোমার সাথে আমি কয়েকজন সাংবাদিকের পরিচয় করিয়ে দেই। প্রত্যেক পত্রিকায় এই খবর ছাপা হওয়া উচিত। আমি পরিচয় করিয়ে দিলাম কয়েকজনের সাথে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, কোনো পত্রিকাতেই নিউজটা আসলো না! কেন, জানিনা! তবে এখন মনে হয় আসবে। কারণ রুবাইয়াত ও তার দল, ২০১৯ সালের এমি অ্যাওয়ার্ড এ, এডোবি সিস্টেমস এর “ক্যারেক্টার এনিমেটর” সফটওয়্যার এর জন্য এমি পুরস্কার জিতে গেছে। এই সফটওয়্যারটি দিয়ে যে কোনো কার্টুনকে ক্যামেরার সামনে জীবন্ত করে তোলা যায়! আমার জানামতে সে প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে টেকনিক্যাল ক্যাটাগরিতে এই পুরস্কারটি পেল। ওদের টিমের প্রত্যেকের বাসায় এক সপ্তাহ করে এমি পুরস্কারটি থেকে তারপর যাবে ওদের অফিসে। এই মুহূর্তে এমি পুরস্কারটি অবস্থান করছে আমাদের বাংলাদেশের, আমাদের বুয়েটের, আমাদের উন্মাদের ছেলে, রুবাইয়াৎ এর বাসায়!
আমি যে এই ঘটনায় কী পরিমাণ খুশি হয়েছি তা বলে বোঝাতে পারবো না। বর্ডার খোলা থাকলে চলে যেতাম রুবাইয়াত এর বাসায় পুরস্কারটি একবার হাতে ছোঁয়ার জন্য। কী অসাধারণ একটা অর্জন! আমি ওকে বললাম, তোমার একটা ছবি দাও, একটা লেখা লিখি। Rubaiat Habib এর এমি পুরস্কারসহ ছবিটি এই লেখার সাথে দিলাম। সাথে ট্যাগ করলাম ওকে। যাতে আমার বন্ধুতালিকায় থাকা সাংবাদিকরা তাকে খুঁজে পায়। এবং তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ, প্রোগ্রামিং এ যাদের আগ্রহ, আবার মনে মনে যারা এনিমেশন বা ভিজুয়াল এফেক্টস এর প্রতি আগ্রহী, তারা যেন রুবাইয়াত কে দেখে অনুপ্রেরণা পায়, এবং নিজ নিজ রাস্তা খুঁজে নেয়।
আর আমি ঠিক করেছি রুবাইয়াত এর সাথে একটা ছবি তুলবো। তুলে টি-শার্ট বানাবো। সেখানে লেখা থাকবে, #কাগোলগেচলি! রুবাইয়াত কে অনেক অনেক শুভকামনা। আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি, আর কী কী ম্যাজিক সে আমাদের দেখাবে সেটার জন্য।

পুনশ্চ: আমি মোটামুটি ৯০% শিউর রুবাইয়াত অস্কারও পাবে। আজ ২১ জুলাই ২০২১ এ ফেইসবুকের এই পোস্টের মাধ্যমে ভবিষ্যৎবাণীটা করে গেলাম।

ওয়াহিদ ইবনে রেজা, ভ্যাঙ্কুভার, কানাডা

২১ জুলাই, ২০২১।

## ওয়াহিদ ইবনে রেজার ফেসবুক থেকে নেয়া।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *