এক সপ্তাহে ৫০ টাকা বেড়ে গেল সিমেন্টের দাম
প্রায় সব কোম্পানির এক সপ্তাহে ৫০ টাকা বেড়ে গেল সিমেন্টের দাম। উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, আন্তর্জাতিক বাজারে সিমেন্টের কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি ও জাহাজভাড়া বাড়ার কারণে সিমেন্টের উৎপাদন খরচ প্রতি বস্তায় ৫০-৬০ টাকা বেড়েছে।
এ অবস্থায় টিকে থাকার স্বার্থে মূল্য সমন্বয় করা হচ্ছে। সিমেন্টের কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি ও জাহাজভাড়া দ্বিগুণ বাড়ায় খুব শিগগির দেশের বাজারে সিমেন্টের দাম ৫০০ টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে অস্থির আন্তর্জাতিক বাজার। জ্বালানি তেলের দামের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বিভিন্ন শিল্পপণ্যের কাঁচামালের দাম। জাহাজের জ্বালানি (মেরিন ফুয়েল) টনপ্রতি ৫০ শতাংশ বেড়েছে। এতে পণ্য পরিবহন ব্যয় বেড়েছে বলে জানিয়েছে খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
সিমেন্ট খাতের উদ্যোক্তারা জানান, সিমেন্ট উৎপাদনে প্রধান পাঁচটি কাঁচামাল ক্লিংকার, লাইমস্টোন, স্ল্যাগ, ফ্লাই অ্যাশ ও জিপসাম ব্যবহৃত হয়, যার সবই আমদানিনির্ভর। এর মধ্যে ৬২ থেকে ৯০ শতাংশই হলো ক্লিংকার। কাঁচামাল ক্লিংকার প্রতি টন ৬০ থেকে বেড়ে ৭৫-৭৯ ডলার হয়েছে। শুধু ক্লিংকারেই ১৫ ডলারের বেশি দাম বেড়েছে। এ ছাড়া অন্যান্য কাঁচামাল লাইমস্টোন, স্ল্যাগ, ফ্লাই অ্যাশ ও জিপসাম গড়ে ১০-১২ ডলার বেড়ে গেছে।
কাঁচামাল তৈরিতে ব্যবহৃত হয় কয়লা। কয়লার দাম বাড়ায় ও করোনা-পরবর্তী বিশ্বব্যাপী ব্যাপকভাবে নির্মাণকাজ শুরু হওয়ায় কাঁচামালের সংকট তৈরি হওয়ায় সিমেন্টের দাম বাড়ছে। এদিকে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি ও জাহাজসংকটের কারণে জাহাজভাড়া আগের চেয়ে দ্বিগুণ হয়েছে বলেও জানান এই খাতের উদ্যোক্তারা।
গতকাল সরেজমিন রাজধানীর খুচরা ও পাইকারি দোকান ঘুরে দেখা যায়, সব কম্পানির সিমেন্টের দাম এক সপ্তাহের ব্যবধানে ৫০ টাকা বেড়েছে। খুচরা হিসেবে সুপারক্রিট ৪২০ থেকে বেড়ে ৪৭০ টাকা, শাহ স্পেশাল ৪২০ টাকা থেকে বেড়ে ৪৭০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। স্ক্যান সিমেন্ট ৪৫০ থেকে বেড়ে ৪৯০-৫০০ টাকা, বেঙ্গল ৪১০ থেকে বেড়ে ৪৬০ টাকা এবং মীর ৪০৫ থেকে বেড়ে ৪৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
রাজধানীর ভাটারা থানার দক্ষিণ কুড়িল এলাকার ট্রেডার হেলমী এন্টারপ্রাইজের মালিক তাসিন রহমান হেলমী বলেন, ‘এক সপ্তাহে দুই ধাপে সিমেন্টের প্রতি বস্তায় ৫০ টাকা বেড়েছে। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে প্রতি বস্তা ৫০০ টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আমরা জানতে পেরেছি। কারণ সিমেন্টের উৎপাদন খরচ বস্তায় ৫০-৬০ টাকা বেড়ে গেছে। ’
গুলশান-২ নদ্দা এলাকার আলপাইন ট্রেডার্সের ম্যানেজার জোবায়ের হোসেন বলেন, ‘গত সোমবার সব কম্পানির সিমেন্ট প্রতি বস্তায় ২০ টাকা বেড়েছে, আবার মাত্র দুই দিন পরেই গত বৃহস্পতিবার বস্তায় ৩০ টাকা বেড়েছে। ’
এদিকে রাজধানীর পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন জেলায়ও সিমেন্টের দাম বেড়েই চলেছে। চট্টগ্রামের পোর্ট কানেকটিং রোডের সরাইপাড়া এলাকার মরিয়ম এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মো. মোমিন বলেন, ‘চট্টগ্রামে এক সপ্তাহে সিমেন্টের দাম বস্তাপ্রতি ৫০ টাকার বেশি বেড়েছে। ভবিষ্যতে দাম আরো বাড়তে পারে। ’
বগুড়ার রাজ্জাক ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী আব্দুর রাজ্জাক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রতিদিন নতুন রেট হচ্ছে। সিমেন্টের দাম যেভাবে বাড়ছে, তাতে ৫০০ টাকা ছাড়িয়ে যাবে। ’
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে জ্বালানি তেলের দাম অনেক বেড়ে গেলে জাহাজভাড়াসহ শিপিং ব্যয় কয়েক গুণ বেড়েছে। এতে বিপাকে পড়েছেন উৎপাদকরা।
জানা যায়, গত বছরের ফেব্রুয়ারির শুরুতেও প্রতি টনে চার ডলার বেড়ে ক্লিংকারের দাম ৪৬ ডলারে ওঠে। বর্তমানে ক্লিংকারের দাম ৬০ ডলার থেকে বেড়ে এক লাফে ৭৫-৭৯ ডলারে উঠেছে। মূল্যবৃদ্ধির যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, তাতে সিমেন্টের দাম দ্বিগুণ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
দেশের জনপ্রিয় এক সিমেন্ট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সিমেন্টের কাঁচামালের দাম ও জাহাজভাড়া অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় দেশীয় সিমেন্ট কম্পানিগুলো ব্যাপক লোকসান দিয়ে যাচ্ছে, যা কোনোভাবেই দীর্ঘদিন চলতে পারবে না। এমতাবস্থায় সিমেন্ট কম্পানিগুলো টিকে থাকার স্বার্থে মূল্য সমন্বয় করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। ’ এখনই যদি মূল্য সমন্বয় না করা হয়, তাহলে সিমেন্ট খাত ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হবে বলেও তিনি জানান।
আন্তর্জাতিক বাজারে সিমেন্টের কাঁচামালের অব্যাহত মূল্যবৃদ্ধি ও জাহাজভাড়া অস্বাভাবিক বৃদ্ধিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিসিএমএ)। সংগঠনটির প্রথম সহসভাপতি মো. শহীদ উল্ল্যাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে দেশের সিমেন্ট ও ইস্পাত শিল্পে অস্থিরতা দেখা দেবে। ওই সব দেশ থেকে আসা কাঁচামালের দর এরই মধ্যে দ্বিগুণ বেড়েছে। এ ছাড়া যুক্ত হয়েছে পণ্য পরিবহন খরচ। এরই মধ্যে ওই সব অঞ্চলে পণ্যবাহী জাহাজ আটকে পড়েছে। ’
দেশে বর্তমানে ৩৫টি দেশি-বিদেশি কম্পানি সিমেন্ট উৎপাদন করছে। প্রায় চার কোটি টন বার্ষিক চাহিদার বিপরীতে ৮.৪ কোটি টন উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে। এ খাতে প্রায় ৪২ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে।