প্রচ্ছদ

একবছরে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে রপ্তানি সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা

ধূমকেতু রিপোর্ট : দেশে সফটওয়্যার ও তথ্যপ্রযুক্তি সেবা খাতে রপ্তানি ২০১৮ সালে ১ বিলিয়ন বা ১০০ কোটি মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। যা টাকার হিসেবে প্রায় সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা।

বাংলাদেশে সফটওয়্যার খাতের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) ও সফটওয়্যার রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

বেসিস সূত্রে জানা গেছে, দেশের অভ্যন্তরীণ সফটওয়্যারের বাজারও বড় হচ্ছে। দেশের বাজার দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার।

এর মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশই আবার দেশি সফটওয়্যার নির্মাতারা দখল করেছেন। তবে বড় প্রতিষ্ঠানের কাজগুলোর ক্ষেত্রে এখনো বিদেশি সফটওয়্যারের ওপর নির্ভরতা থেকে গেছে।

দেশের ৬০টি ব্যাংকের মধ্যে ২৭টি ব্যাংকেই দেশি সফটওয়্যার ব্যবহৃত হচ্ছে। দেশের সফটওয়্যার খাতে বেশি চাহিদা রয়েছে ইআরপি, বিভিন্ন অ্যাপ্লিকেশন তৈরিসহ, ডিজিটালাইজেশনের কাজে ব্যবহৃত সফটওয়্যার।

বেসিসের সভাপতি আলমাস কবীর বলেন, দেশের বাজারে চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি এখন আমাদের সফটওয়্যার নির্মাতারা বিদেশেও রপ্তানি করছে। তবে আমাদের দেশ থেকে বড় ধরনের একক সফটওয়্যার রপ্তানি হাতে গোনা।

এখন পর্যন্ত আমরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিপিও, সার্ভিস রপ্তানি করছি বেশি। বিপিওর ক্ষেত্রে ব্যাংকের নানা কাজ, নানা রকম সেবা দেওয়া হচ্ছে। ফ্রিল্যান্সিংয়ে গ্রাফিকস, ওয়েবের কাজ হচ্ছে।

তবে এ ক্ষেত্রে সফটওয়্যার এখনো রপ্তানির সব অর্থ ব্যাংকের মাধ্যমে আসেনা বলেন প্রকৃত তথ্য পাওয়া কঠিন। তা ছাড়া সফটওয়্যার খাতের প্রকৃত আয় নিয়ে কোনো জরিপ নেই। এর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

এর আগের ২০১৭ সালের তথ্য অনুযায়ী, সরকারি হিসাবে ৮০০ মিলিয়ন (৮০ কোটি) ডলারের সফটওয়্যার রপ্তানি করেছিল বাংলাদেশ। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর নাগাদ এক বিলিয়ন ডলারের সফটওয়্যার রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। এ মাইলফলক বছরের শুরুতেই পার হয়েছে বলে জানান বেসিসের সভাপতি।

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সরকারের টার্গেট বা লক্ষ্য ছিল, ২০১৮ সালের মধ্যে এক বিলিয়ন রপ্তানি আয় করা। এ ছাড়া ২০২১ সালের মধ্যে ৫ বিলিয়ন ডলারের সফটওয়্যার ও সেবাপণ্য রপ্তানি করা। সফটওয়্যার রপ্তানিতে ক্যাশ ইনসেনটিভ দেওয়াসহ, এখাতের উন্নয়নের নেওয়া নানা পদক্ষেপের কারণে ২০১৮ সালে সফটওয়্যার রপ্তানি বেড়েছে।

অবশ্য বেসিসের করা হিসাবের সঙ্গে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হিসাবের বড় পার্থক্য থাকে। ইপিবির হিসাবে ফ্রিল্যান্সার, সফটওয়্যার ডেভেলপার ও কল সেন্টারগুলোর সেবা রপ্তানির আয় দেখানো হয় না। কিন্তু বেসিসের অনানুষ্ঠানিক তথ্য অনুযায়ী, ১ বিলিয়নের মাইলফলক পার হয়ে গেছে আগেই।

ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত কম্পিউটার সার্ভিস থেকে রপ্তানি ছিল ১০ কোটি ৭১ লাখ মার্কিন ডলার। ইনফরমেশন সার্ভিসেসের রপ্তানি আয় ৩০ লাখ ৭৬ হাজার মার্কিন ডলার। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে কম্পিউটার সার্ভিস থেকে মোট আয় ছিল ১৮ কোটি ২০ লাখ মার্কিন ডলার।

ইনফরমেশন সার্ভিসেস থেকে আয় ছিল ৬০ লাখ ৪৬ হাজার মার্কিন ডলার। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের তুলনায় ২২ দশমিক ৯৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি দেখা গেছে আর ইনফরমেশন সার্ভিসেসের ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি ৯০ দশমিক ৮৬ শতাংশ।

ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, ‘আগে আমাদের নিয়ে এক ধরনের নেতিবাচক মনোভাব কাজ করত। এখন আমরা সব দিক থেকেই নেতিবাচক ধারণাটিকে ইতিবাচক করতে পেরেছি।

আমাদের ইন্ডাস্ট্রি এক বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি করতে পারবে কেউ বোধ হয় বিশ্বাস করতে পারেনি। এখনো হয়তো কেউ বিশ্বাস করতে চাইবে না, আমরা ৫ বিলিয়নে পৌঁছাতে পারব। বাংলাদেশ এখন স্বপ্ন দেখে, স্বপ্ন দেখাতে পারে। এ স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারে। এর বড় কৃতিত্ব হচ্ছে আমাদের তরুণ প্রজন্ম।’

মন্ত্রী বলেন, তথ্যপ্রযুক্তি খাতে রপ্তানির মানে শুধু সফটওয়্যারে সীমাবদ্ধ নয়। বাংলাদেশ হার্ডওয়্যারেও উন্নতি করছে।

দেশিয় সফটওয়্যার ব্যবহার প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, ‘আমি নিশ্চয়তা দিতে পারি ৯০ শতাংশ পর্যন্ত দেশি সফটওয়্যার ব্যবহার করা হবে। আমরা বিদেশি সফটওয়্যারকে রিপ্লেস করছি। বিদেশি সফটওয়্যারের জায়গায় দেশি সফটওয়্যার প্রতিস্থাপন করতে পেরেছি।

আমাদের সফটওয়্যার ১৮০টি দেশে রপ্তানি হয়। আমাদের সফটওয়্যার আয়ারল্যান্ডের পুলিশ ব্যবহার করে, সিকিউরিটি জন্য আমাদের সফটওয়্যার আছে, মোবাইল অপারেটররা ব্যবহার করছে। এটার গতি অতীতের সঙ্গে তুলনা করলে সম্ভাবনা এখন অনেক বেশি।’

তথ্যপ্রযুক্তি ও সফটওয়্যার রপ্তানিতে অগ্রগতির চিত্র:

বেসিস সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ থেকে ১৯৯৯-২০০০ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো ২৮ লাখ (২.৮ মিলিয়ন) ডলারের সফটওয়্যার রপ্তানি হয়। আনুষ্ঠানিকভাবে ২০০৩ সালে বাংলাদেশ সফটওয়্যার রপ্তানি শুরু করে। ওই বছর রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৭২ লাখ ডলার।

এরপর ২০০৪-২০০৫ অর্থবছরে এক কোটি ২৬ লাখ ডলার, ২০০৫-২০০৬ অর্থবছরে ২ কোটি ৭০ লাখ ডলার, ২০০৬-০৭ অর্থবছরে ২ কোটি ৬০ লাখ ডলার, ২০০৭-২০০৮ অর্থবছরে ২ কোটি ৪৮ লাখ ডলার, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ৩ কোটি ২৯ লাখ ডলার, ২০০৯-১০ অর্থবছরে ৩ কোটি ৫৩ লাখ ডলার, ২০১০-১১ অর্থবছরে চার কোটি ডলার,

২০১২-১৩ অর্থবছরে ১০০ মিলিয়ন (১০ কোটি) ডলার অতিক্রম করে। ওই অর্থবছরে মোট রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১০ কোটি ১৬ লাখ ৩০ হাজার ডলার। এই আয় বেড়ে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ১২ কোটি ৪৭ লাখ ২০ হাজার ডলার ও ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে প্রায় ১৩ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এই খাত থেকে সর্বোচ্চ ৭০০ মিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয় হয়।

নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা আর সমস্যা পাশ কাটিয়ে সফটওয়্যার খাত সামনে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে বলে জানান প্রযুক্তি খাত সংশ্লিষ্টরা। সফটওয়্যার ও তথ্যপ্রযুক্তি সেবা রপ্তানির অবস্থাও যথেষ্ট ভালো বলে মনে করছেন অনেকই। এই খাত বর্তমানে শীর্ষস্থানীয় ১৫টি রপ্তানি খাতের একটি।

আইটি ও আইটি সক্ষম সেবা (আইটি-আইটিইএস) শিল্পের ‘বেটিং অন দ্য ফিউচার-দ্য বাংলাদেশ আইটি-আইটিইএস ইন্ডাস্ট্রি’ শীর্ষক শ্বেতপত্রে ২০১৭ সালে স্থানীয় আইটি ও আইটিইএস শিল্পের রাজস্ব উৎপাদন ০.৯-১. ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ২০২৫ সালে তা পাঁচ গুন বেড়ে ৪.৬-৪. ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হতে পারে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়।

সফটওয়্যার খাতে কাজের চিত্র

বর্তমানে সফটওয়্যার খাতের যেসব পণ্য রপ্তানি হচ্ছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ওয়েবসাইট তৈরি ও ডিজাইন, মোবাইল অ্যাপস, গেমস, অ্যাপ্লিকেশন প্ল্যাটফর্ম, ভিওআইপি অ্যাপ্লিকেশন, ডেটা এন্ট্রি, গ্রাফিক ডিজাইন, প্রি-প্রেস, ডিজিটাল ডিজাইন, সাপোর্ট সেবা, কাস্টমাইজড অ্যাপ্লিকেশন তৈরি, রক্ষণাবেক্ষণ ইত্যাদি।

ভারত, চীন ও ইউরোপের দেশগুলোর পাশাপাশি এখন ফিলিপাইন, পাকিস্তানের মতো দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে। তবে দেশে শিক্ষার মানোন্নয়ন ও দক্ষ জনশক্তি তৈরির মাধ্যমে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আমাদের এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে।

এ ক্ষেত্রে স্থানীয় বাজারকেও গুরুত্ব দিতে হবে। এ ছাড়া ব্লকচেইন, আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্সের মতো চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে মানানসই প্রযুক্তি নিয়ে দেশি উদ্যোক্তাদের কাজ করতে হবে।

বাংলাদেশে সফটওয়্যার উন্নতির ধারাকে ইতিবাচক বলে মনে করছেন দেশের প্রযুক্তি সংশ্লিষ্টরা। বিদেশিরাও বাংলাদেশের সফটওয়্যার খাতে আগ্রহ দেখাতে শুরু করেছে। বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানের তৈরি সফটওয়্যারে আগ্রহ দেখিয়েছে ভুটান, মালদ্বীপ ও কঙ্গো।

এর আগে বাংলাদেশি সফটওয়্যার নির্মাতারা খুব ভালো কাজ করছেন বলে প্রশংসা করেন ভুটানের তথ্য ও যোগাযোগমন্ত্রী দীননাথ দুঙ্গায়েল, মালদ্বীপের সশস্ত্র ও জাতীয় নিরাপত্তা উপমন্ত্রী তারিক আলী লুথুফি ও কঙ্গোর প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য উপদেষ্টা ডাইডোন কালোম্বো।

বাংলাদেশের সাইবার সিকিউরিটি ব্র্যান্ড রিভ অ্যান্টিভাইরাসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সঞ্জিত চ্যাটার্জি জানান, ২০০৭ সাল থেকেই তাদের সফটওয়্যার ভারত ও নেপালে রপ্তানি হচ্ছে। এখন আফ্রিকার কেনিয়া ও তানজানিয়াতে রপ্তানি শুরু হয়েছে। শিগগিরই ইউক্রেনসহ আরও কয়েকটি দেশে বাংলাদেশি সফটওয়্যার রপ্তানি শুরু হবে। এর আগে আয়ারল্যান্ডের পুলিশ বাংলাদেশের সফটওয়্যার ব্যবহার করেছে। খবর : প্রথম আলো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *