নিখিল মানখিন, ধূমকেতু ডটকম: ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিইউ)। সংকটাপন্ন রোগীকে সব রকমের সাপোর্ট দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনাই এই ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা জানান, এখানে জটিল ও মুমূর্ষু রোগীকে রেখে বিশেষ ব্যবস্থায় চিকিৎসা করানো হয়। মানব শরীরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কিডনি, লিভার, ফুসফুস ও মস্তিষ্ক বিকল হয়ে গেলে তখন আইসিইউ’তে রেখে বিশেষ কিছু যন্ত্রের সাহায্যে এগুলো সচল করা যায়। বড় কোনো সার্জারি বা অপারেশনের পর কিছু রোগীর আইসিইউ দরকার। গুরুতর দুর্ঘটনায় আঘাত পেয়ে জ্ঞান হারানো এবং গুরুতর শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত সমস্যার রোগীরও আইসিইউ দরকার হয়।
দেশের বেসরকারী হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটের (আইসিইউ) মান তদারকিতে বহুবার মাঠে নেমেছে স্বাস্থ্য অধিদফতরের বিশেষ মনিটরিং টিম। অনেক বেসরকারী হাসপাতালের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সুবিধা ও উপকরণ ছাড়াই আইসিইউ পরিচালনার পাশাপাশি উচ্চ আইসিইউ ফি আদায়ের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমনিতেই দেশে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিইউ) চিকিৎসা সুবিধা খুবই সীমিত। দেশের চার-ভাগের তিন ভাগ সরকারী হাসপাতালে এ চিকিৎসা সুবিধা নেই। প্রয়োজনের সময় আইসিইউ চিকিৎসা সুবিধা না পেলে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন অনেক রোগী। অনেক প্রাইভেট হাসপাতালে এ চিকিৎসা সুবিধা থাকলেও তা ব্যয়বহুল। গরিব রোগীর পক্ষে আকাশচুম্বি এ চিকিৎসা ব্যয় বহন করা সম্ভব হয়ে ওঠে না।
তাছাড়া অধিকাংশ বেসরকারী হাসপাতালের আইসিইউ চিকিৎসাসেবা দীর্ঘদিন ধরে প্রশ্নবিদ্ধ। আইসিইউর নামে উচ্চ চিকিৎসা ফি আদায় করছে অনেক বেসরকারী হাসপাতাল। সার্বক্ষণিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক থাকেন না। সরকারী হাসপাতাল থেকে চিকিৎসক ডেকে নিয়ে নামমাত্র আইসিইউ সেবার কাজ চালানো হয় বলে বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ উঠেছে। জীবন বাঁচানোর ভরসাস্থল আইসিইউ’র মান নিয়ে আপোষ করা যাবে না বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা।
বিশেষজ্ঞরা জানান, আইসিইউ যে কোনও হাসপাতালের একটি নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র। এতে কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাস যন্ত্র, হার্ট মনিটরসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি থাকে। এখানে মুমূর্ষু রোগীর চিকিৎসা দেন এ্যানেসথেসিয়া এ্যানালজেসিয়া ও ইনটেনসিভ কেয়ার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। আর ইমার্জেন্সি চিকিৎসা বলতে দুর্ঘটনা বা অপঘাতের রোগীর জীবন রক্ষায় তাৎক্ষণিক চিকিৎসা। এ ক্ষেত্রে অক্সিজেন, ওষুধ, ছোটখাটো অপারেশন, রক্ত ও আইভি স্যালাইনের ব্যবস্থা। আইসিইউ চিকিৎসার ব্যয় অনেক বেশি, তবে এটি চালু করতেও অনেক টাকার প্রয়োজন। ১০ বেডের একটি আইসিইউ চালু করতে কমপক্ষে ২ কোটি টাকা লাগে। অভিজ্ঞ চিকিৎসক, নার্সও নিয়োগ দিতে হয়। তাই ছোটখাটো হাসপাতালে এ ধরনের চিকিৎসা ব্যবস্থা থাকে না।
বিশেষজ্ঞরা জানান, দুর্ঘটনার রোগীর চেতনা থাকা অবস্থায় শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে পাঁচ থেকে ১০ মিনিটের মধ্যে এবং এ্যাজমা বা অন্য কোনও রোগের কারণে এমনটি হলে দু-এক ঘণ্টা বিলম্বে মেডিসিন বা আইসিইউ সেবা পেলেও রোগী বেঁচে যান। সড়ক দুর্ঘটনাসহ যে কোনও অপঘাতে জ্ঞান হারানোর পর মানুষের শরীরে মাত্র তিন থেকে পাঁচ মিনিট অক্সিজেন থাকে। কিন্তু এ সময়ের মধ্যে ইমার্জেন্সি মেডিসিনের নাগাল খুব কম মানুষই পান।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এ্যানেসথেসিয়া, এ্যানালজেসিয়া, এ্যান্ড ইনটেনসিভ কেয়ার মেডিসিনের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা জানান, আইসিইউতে রোগীকে ওঠা-নামা, কাত করানোসহ বিভিন্ন অবস্থানে রাখার জন্য বিশেষায়িত শয্যার দরকার। প্রত্যেক রোগীর জন্য পৃথক ভেন্টিলেটর (কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র) ও কার্ডিয়াক মনিটর (হৃদযন্ত্রের অবস্থা, শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা, কার্বন-ডাই অক্সাইড নির্গমনের মাত্রা, শ্বাসপ্রশ্বাসের গতি, রক্তচাপ পরিমাপক), ইনফিউশন পাম্প (স্যালাইনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম মাত্রা নির্ধারণ যন্ত্র) দরকার।
আইসিইউতে শক মেডিশন (হৃদযন্ত্রের গতি হঠাৎ থেমে গেলে তা চালু করার যন্ত্র), সিরিঞ্জ পাম্প (শরীরে ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে যে ওষুধ প্রবেশ করানো হয় তার মাত্রা নির্ধারণের যন্ত্র), ব্লাড ওয়ার্মার (রক্ত দেয়ার আগে শরীরের ভেতরকার তাপমাত্রা সমান করার জন্য ব্যবহৃত যন্ত্র) থাকবে। পাশাপাশি কিডনি ডায়ালাইসিস মেশিন, আল্ট্রাসনোগ্রাম, এবিজি মেশিন (মুমূর্ষু রোগীর রক্তে বিভিন্ন উপাদানের মাত্রা নির্ধারণ) থাকতে হবে। জরুরী পরীক্ষার জন্য আইসিইউসির সঙ্গে একটি পরীক্ষাগার থাকাও আবশ্যক বলে জানান বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।
কাদের আইসিইউ প্রয়োজন:
কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের ক্রিটিক্যাল কেয়ার মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান জানান, আইসিইউ দরকার পড়ে তাদের, যাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের হার প্রতি মিনিটে ৩০-এর বেশি হচ্ছে রক্তে অক্সিজেনের ঘনত্ব বা স্যাচুরেশন শতকরা ৯৩ ভাগের নিচে নেমে এসেছে এবং রোগীর অক্সিজেনের চাহিদা ধীরে ধীরে বাড়ছে। রোগীর আঙুলে পাল্স অক্সিমিটার নামের একটি যন্ত্র লাগিয়ে কিংবা ল্যাবরেটরিতে রক্তের এবিজি করে এর মাত্রা নিরূপণ করা সম্ভব। যাদের অতিরিক্ত শ্বাসকষ্ট হচ্ছে মেডিকেল পরিভাষায় যাকে এআরডিএস বলে। বুকের একটি এক্সরে বা সিটিস্ক্যান করে এটি সহজে নিরূপণ করা যায়। যাদের মাল্টি অরগান ফেইলুরের মতো সমস্যা হচ্ছে অর্থাৎ দেহের একাধিক অঙ্গের কার্যকারিতা ক্রমেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে রোগীর রক্তচাপ কমে যায় বা পাল্স রেট বা নাড়ির স্পন্দন বেড়ে যেতে থাকে। যাদের আগে থেকেই ফুসফুসের বা শ্বাসযন্ত্রের বিভিন্ন অসুখ রয়েছে যেমন অ্যাজমা, সিওপিডি। এছাড়া যারা ধূমপায়ী ও যাদের দীর্ঘদিন থেকে ডায়াবেটিস আছে তাদেরও শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটতে পারে। তাদের আইসিইউ লাগতে পারে।
আইসিইউতে কী করা হয়:
ডা. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান জানান, প্রথমেই অক্সিজেনের মাত্রা বাড়ানোর ব্যবস্থা করা হয়। যত দ্রুত এ কাজটি করা যাবে রোগীর ভালো হওয়ার সম্ভাবনা তত বাড়বে। এটি করার জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়। রোগীভেদে সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইনের মাধ্যমে নাসাল ক্যানুলা বা ফেস মাস্ক দিয়ে ৫-১৫ লিটার প্রতি মিনিটে অক্সিজেন দেয়া হয়। এটি অক্সিজেন সিলিন্ডারের মাধ্যমেও করা সম্ভব। রক্তের রিপোর্ট দেখে কিংবা কোনো রোগী যদি খুব মুমূর্ষু থাকে তাহলে শিরাপথে উপযুক্ত অ্যান্টিবায়োটিক ৭ দিন দেয়া হয়। নেবুলাইজার, বাইপেপ বা সিপেপ মেশিন দিয়ে আইসিইউ বা হাসপাতালে চিকিৎসা করা নিরুসাহিত করা হয়। কারণ এ মেশিনের সাহায্যে করোনাভাইরাসের জীবাণু স্বাস্থ্যকর্মী ও অন্য রোগীদের মাঝে ছড়াতে পারে। বাসায় এ মেশিনের সাহায্যে চিকিৎসার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করে করা যায়, এ রোগীদের বরং কিছু ক্ষেত্রে ইনহেলার ব্যবহার করতে বলা হয়। ঘন ঘন অর্থাৎ প্রতি ১৫-৩০ মিনিট পরপর রোগীর রক্তচাপ মাপা হয়। প্রয়োজনে ধমনির ভেতর মেশিন ঢুকিয়ে এ পরীক্ষা করা হয়। বেশিরভাগ রোগীই আইসিইউতে চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যায়।
এক্ষেত্রে ডাক্তারের নির্দেশিত মেডিসিনগুলো বাসায় গ্রহণ করতে হবে এবং রক্তের জমাটরোধী অ্যান্টিকোয়েগুলেন্ট ওষুধ এক থেকে দেড় মাস গ্রহণ করতে হয়। রোগী মেশিনের কোনো মোড ও কত পিপে চলবে তা রোগীর অবস্থার ওপর নির্ভর করে নির্ধারণ করা হয়।
ঢাকা কমিউনিটি মেডিকেল কলেজের অ্যানেসথেসিওলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. শাহেরা খাতুন জানান, আইসিইউ বা নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র হাসপাতালের একটি বিশেষায়িত বিভাগ। এখানে জটিল রোগীর চিকিৎসা করা হয়। অ্যানেসথেসিয়া বিষয়ের যে পাঁচটি স্তম্ভ রয়েছে, এর মধ্যে একটি হলো আইসিইউ। আমাদের শরীরে তো অনেক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কাজ করে, যেমন—কিডনি, লিভার, হার্ট, ফুসফুস, মস্তিষ্ক। এর মধ্যে তো হার্ট ও ফুসফুসের তুলনা হয় না। এর মধ্যে তো কিডনি, লিভারও রয়েছে। কোনো কারণে যদি এই অঙ্গগুলো বিকল হয়ে যায়, কাজ করতে না পারে, তখন বিশেষ যন্ত্রের সহযোগিতায় আমরা ওই অঙ্গগুলো সচল করতে পারি। সচল করার জন্য ওই রোগীদের সাধারণ ওয়ার্ডে রাখা সম্ভব নয়। তখন তাদের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে নেওয়া হয়। আইসিইউ মানে কিন্তু এই নয় যে তাকে কৃত্রিমভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। এই যে পাঁচ/ছয়টি অঙ্গের কথা বললাম, এর মধ্যে একটি খারাপ হয়ে গেলেই তার আইসিআইর সহযোগিতার প্রয়োজন হয় বলে জানান অধ্যাপক ডা. শাহেরা খাতুন।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলেন, প্রত্যেক ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটের ভূমিকা একই, তৎপরতার সঙ্গে সঙ্কটজনক অবস্থার মোকাবিলা করে রোগীকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা। এই অবস্থায় রোগীর পুষ্টির ওপরেও বেশি জোর দেওয়া হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নাকে নল দিয়ে পুষ্টি সরবরাহ করা হয়। ইমিউনো নিউট্রিশন (যেমন আরজাইনিন, ওমেগা সিক্স ফ্যাটি অ্যাসিড, নিউক্লিওটাইডস, গ্লুটামিন ইত্যাদি) দিয়ে রোগীর পুষ্টির ঘাটতি মেটানো হয়। ক্রিটিক্যাল কেয়ার চিকিৎসা পরিষেবায় একজন রোগীর পেছনে ২৪ ঘন্টা স্বাস্থ্য কর্মী ও স্পেসালিষ্ট চিকিৎসক মোতায়েন থাকেন। এই দক্ষ হিউম্যান রিসোর্সের মূল্য যথেষ্ট বেশি।
আরো পড়ুন:
দাতার বাকি অংশ লিভার ১২ সপ্তাহের মধ্যে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে