নিজস্ব প্রতিবেদক, ধূমকেতু ডটকম: করোনাভাইরাসের গণ টিকাদানের দ্বিতীয় দিনে ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রগুলোতে টিকা গ্রহীতাদের উপস্থিতি বেড়েছে। রাজধানীর বেশ কিছু হাসপাতাল ও টিকাদান কেন্দ্র ঘুরে উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়েই মানুষকে টিকা নিতে দেখা গেছে। অনেক প্রবীণ স্বজনদের সঙ্গে এসে টিকা নিয়ে বলেছেন, প্রাণঘাতী এই ভাইরাস থেকে এখন নিরাপদ বোধ করছেন তারা।
দ্বিতীয় দিন সোমবার সকাল ৮টা থেকে বেলা আড়াইটা পর্যন্ত টিকা দেওয়া হয়। করোনাভাইরাস মোকাবেলার সম্মুখযোদ্ধাদের সঙ্গে বয়সে প্রবীণ ও মুক্তিযোদ্ধাসহ কয়েকটি শ্রেণির নাগরিকরা প্রথম দিকে টিকা পাচ্ছেন। এদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে আটটি বুথ থেকে করোনাভাইরাসের টিকা দেয়া হয়। নারীদের জন্য রাখা হয় আলাদা বুথ।
টিকা গ্রহণে ব্যাপক সাড়া মিলছে। সবাই সুশৃঙ্খলভাবে টিকা নিচ্ছে। অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং ডায়াবেটিস রোগী টিকা নেওয়ায় মানুষের মাঝে ভয় ও জড়তা কেটে গেছে। ভ্যাকসিন নেওয়ার পর বিশ্রামের ব্যবস্থা আছে।
স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত ৮৪ বছর বয়সী চিকিৎসক ডা. এএইচএম তৌহিদুল আনোয়ার চৌধুরী (ডা. টিএ চৌধুরী) সোমবার সকালে টিকা গ্রহণের পর বলেন, “টিকা নেয়ার ক্ষেত্রে বয়স কোনো বিষয় নয়। বয়স কিংবা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার চিন্তা না করে সবারই টিকা নেয়া উচিত। একথা প্রমাণিত যে, টিকা প্রটেকশন দেয়। কতদিন দেয় বা কতক্ষণ থাকবে, এটা আমরা জানি না। কিন্তু প্রটেকশন দেবে, এটা নিশ্চিত। যাদের বয়স বেশি, যারা ভালনারেবল তাদের সবার টিকার আওতায় আসা উচিত।”
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংগীত শিল্পী রফিকুল আলম ও তার স্ত্রী আবিদা সুলতানাও এদিন টিকা নেন। টিকা নেয়ার পর প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান রফিকুল আলম। তিনি বলেন, সরকার অত্যন্ত চমৎকার ব্যবস্থাপনায় টিকাদান কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
“আমি ছোটবেলা থেকে অনেক টিকা নিয়েছি। তখন তো টিকা নেয়া অনেক কষ্টকর ছিল- ঘা হয়ে যেত, ইনফেকশন হয়ে যেত। আজকে ভ্যাকসিন নেওয়ার পর কোনো প্রতিক্রিয়া অনুভূত হল না। মাত্র ৩-৮ সেকেন্ড লাগে। ভয় পাওয়ার কোনা কারণই দেখছি না।”
কণ্ঠশিল্পী আবিদা সুলতানা বলেন, “টিকা নিয়ে নিজেকে অনেক হালকা লাগছে। মনে হচ্ছে, অনেক বড় একটা বোঝা নেমে গেল। কোনো টেনশনের কারণ নেই। কোনো ব্যাথাও পাইনি।”
বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে টিকা নিতে রাজাবাজার থেকে আসেন ৭০ বছর বয়সী ফজলুল করিম।
তিনি বলেন, “ভেবেছিলাম টিকা দিলে কী যেন হয়। এই বয়সে আরও অনেক রোগ-ব্যাধি নিয়ে টিকা নেয়া নিরাপদ হবে কি না? আসলে টিকা নেয়ার পর ভালোই লাগছে। নিজের মধ্যে একটু সাহস পাচ্ছি। করোনা থেকে কিছুটা হলেও নিরাপদ মনে হচ্ছে।”
প্রথম দিনের চেয়ে সোমবার টিকা গ্রহীতাদের উপস্থিতি বেশি ছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও। হাসপাতালের উপ-পরিচালক আলাউদ্দিন আল আজাদ জানান, তাদের এখানে টিকা দেয়া শুরুর ঘণ্টাখানেকের মধ্যে প্রায় একশ জন টিকা নিয়েছেন।
সকালে টিকা নেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ খান আবুল কালাম আজাদ।এই হাসপাতালের একটি বুথে দায়িত্বরত চিকিৎসক তাসমিনা পারভীন বলেন, “আগের দিনের চেয়ে বেশি মানুষ টিকা নিতে এসেছে।”
রেজিস্ট্রেশন করে টিকা কার্ড আনলেই তাদের টিকা দেয়া হচ্ছে, এসএমএসের প্রয়োজন নেই।
রাজধানীর মহাখালীর জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে বেলা সোয়া ১২টা পর্যন্ত পাঁচটি বুথে ৭৮ জন টিকা নেন। তাদের একজন আফতাবনগর এলাকার বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা আবুল হোসেন। বেলা সাড়ে ১১টায় টিকা নিয়ে বিশ্রাম করছিলেন তিনি।
আবুল হোসেন বলেন, করোনাভাইরাস থেকে সুস্থ থাকার জন্য টিকা নিয়েছেন তিনি।
“এটা তো সাধারণ বিষয়। আমি এমনিতেই অসুস্থ। কিন্তু টিকা নেওয়ার মতো অবস্থা আছে। এ কারণে টিকা নিয়েছি। এই বয়সে করোনাভাইরাস সংক্রমিত হলে তো বিপদ।”
মধ্য বাড্ডা থেকে পারভীন সরকার গীতাকে নিয়ে আসেন তার মেয়ে শর্মিলা রায়। শর্মিলা বলেন, “টিকা নিলে তিনি সুস্থ থাকবেন এবং বাকিরা নিরাপদ থাকবে। এ কারণে নিয়ে এসেছি।” পারভীন সরকার গীতা জানান, টিকা নিয়ে কোনো সমস্যা হচ্ছে না তার। অন্য সময় ইনজেকশন নিলে যেমন, এখনও তেমন লাগছে। অস্বাভাবিক কিছু মনে হচ্ছে না, খারাপ লাগছে না।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের উপাধ্যক্ষ ডা. শাহাদত হোসেন জানান, এই হাসপাতালে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ টিকা নিচ্ছেন। প্রথমদিন এই হাসপাতালে চার হাজার নিবন্ধন করেছেন। তাদের মধ্যে ২০০ জনকে মোবাইলে বার্তা পাঠানো হয়েছে। প্রথম দিন টিকা দেয়া হয়েছে ১২৬ জন পুরুষ এবং ৭৭ জন নারীকে।
সকাল ১০টার পর শ্যামলীর ২৫০ শয্যার টিবি হাসপাতালে টিকা নিতে আসেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার। এ সময় খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুমও করোনাভাইরাসের টিকা নেন। টিকা নিয়ে সাধন চন্দ্র মজুমদার সাংবাদিকদের জানান, স্বাভাবিক আছেন তিনি। টিকা নিয়ে একটি পক্ষ অপপ্রচার চালাচ্ছে মন্তব্য করে সরকারের এই মন্ত্রী বলেন, “মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় থেকে অপপ্রচার চলছে। জনগণকে বাঁচাতে ভ্যাকসিন, মেরে ফেলার জন্য নয়। শুরুতে এক পক্ষ বলেছে, ভ্যাকসিন আসবে না। আসার পর বলেছে, নেওয়া যাবে না। বিরোধী দল বলেছে, এমপি-মন্ত্রী নিলে আস্থা আসবে। তাই আমরা নিয়েছি।”
প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী মশিউর রহমান হুমায়ূন, প্রধানমন্ত্রীর প্রটোকল অফিসার শামিম মুশফিক, প্রধানমন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব-২ গাজী হাফিজুর রহমান লিকু বেলা আড়াইটার দিকে রাজধানীর নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে টিকা নেন।
মশিউর রহমান হুমায়ূন বলেন, “অত্যন্ত উৎসবমুখর পরিবেশে আজ ভ্যাকসিন গ্রহণ করলাম। কোনো ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই।”
প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী এবং তার স্ত্রী আসমা চৌধুরী সকালে ঢাকা সিএমএইচে গিয়ে টিকা নেন বলে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যেও করোনাভাইরাসের টিকা নেওয়ার আগ্রহ বেড়েছে। সচিবালয় ক্লিনিকে এদিন সকাল সাড়ে ৮টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত টিকা দেওয়া হয়। সেখানকার সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াস চৌধুরী বলেন, “ক্লিনিকে বর্তমানে ৩০০ জনকে টিকা দেয়ার সক্ষমতা রয়েছে। সোমবার ২৫৭ জনকে টিকা দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১১৯ জন পুরুষ এবং ৩৮ জন মহিলা।”