মাতৃভূমি

উপমহাদেশে ভূমি ব্যবস্থাপনার ইতিহাস ও বাংলাদেশ প্রসঙ্গ

লিমন নন্দী :

বলা হয়ে থাকে নিষ্প্রাণ বস্তুর কোনো শত্রু নেই। কিন্তু ভূমি বা মাটির ক্ষেত্রে কখনো তা প্রযোজ্য হয় কি? পৃথিবীর ইতিহাসে যত শত্রুতা, যত কলহ, মারামারি হানাহানি হয়েছে তার অধিকাংশই এই ভূমিকে ঘিরে হয়েছে। বাংলাদেশে যত অপরাধ সংঘটিত হয় তার বৃহৎ অংশ হচ্ছে নিস্প্রাণ ভূমি। এই ভূমির ইতিহাসে রয়েছে অনেক যুদ্ধ, অনেক রক্ত আর অনেক জীবনাবসানের কাহিনী। যা আমরা সকলেই কিছু না কিছু জানি। কিন্তু এই ভূমি ব্যবস্থাপনার ইতিহাস রয়ে গেছে অনেকেরই অজানা।

ইতিহাস সবসময় ইতিহাসই। সেটাকে নতুন করে রঙ লাগিয়ে পরিবর্তন করা যায় না। বাংলাদেশের ভূমি ব্যবস্থাপনার ইতিহাস সম্পর্কে অনেকেই কম বেশি জানি। তবুও স্মৃতিটাকে মাঝে মাঝে উঁকি দিয়ে না দেখলে সে-ও একসময় ইতিহাস হয়ে যায়। আজও সেরকম একটা বিষয়কে উঁকি দিয়ে দেখতেই এই লেখার আগ্রহ।

ঠিক বাংলাদেশ বললে ভুল হবে। উপমহাদেশের আদি ভূমির ইতিহাস থেকে আমরা বর্তমান বাংলাদেশের ভূমি ব্যবস্থাপনা পর্যন্ত খুব সংক্ষেপে আলোকপাত করবো আজ। আসুন জেনে নেই উপমহাদেশ ও বাংলাদেশের ভূমি ব্যবস্থাপনার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।

বাংলাদেশের ভূমি ব্যবস্থাপনার ইতিহাস অতি প্রাচীন। এই ইতিহাসকে বিভিন্ন আমলে ভাগ করা হয়। আদি যুগ, হিন্দু বা বৌদ্ধ শাসনামল, মুঘল, পাঠান ও সুলতানী আমল ইত্যাদি। মূলত শেরশাহের শাসনামলে ভূমি ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়।

আদিযুগে সর্ব প্রথম ভূমির ব্যবহার শুরু হয়। আদিবাসি তথা হাজং, মুরং, কুকি, খাসিয়া, সাঁওতাল ইত্যাদি সম্প্রদায় খাদ্য চাহিদা মিটানোর তাগিদে বনজঙ্গল পরিস্কার করে চাষাবাদ করত এবং সেখানে দল বেঁধে বসবাস করত। বসবাসের এই স্থানকে ‘পাড়া’ বলা হতো এবং পাড়ার প্রধানকে সরদার বা মুন্ডা বলা হতো। মুন্ডারা দলীয় সদস্যদের মধ্যে জমি বন্টন করে দিতেন এবং উৎপাদিত ফসলের কিছু অংশ মুন্ডাকে উপহার দেয়া হতো।

প্রাচীন হিন্দু যুগ:  এ সময়ে যিনি জঙ্গল কেটে জমি বানাতেন তিনি জমির মালিক হতেন। জমি হস্তান্তরের মালিকের স্বীকৃত অধিকার ছিল। কৃষি জমি কৃষকদের স্থায়ী বন্দোবস্ত দেওয়া হতো। গ্রাম ছিল ভূমি ব্যবস্থাপনার মূল ভিত্তি। গ্রামের কয়েকটি পরিবার সমবায়ী ব্যবস্থায় ভূমি ব্যবহার করতেন। রাজা ছিল রাজ্যের একচ্ছত্র অধিপতি। তিনি রাজ কর্মচারীদের মাধ্যমে রাজস্ব আদায় করতো। কোনও জমিদার বা মধ্যস্বত্বভোগী ছিল না।

 মুসলিম যুগ: সুলতানী আমলে গ্রামীণ ব্যবস্থার পরিবর্তে জমিদারী ব্যবস্থায় রাজস্ব আদায় করা হতো। ইতিহাস হতে জানা যায় প্রথম জরিপ কাজ পরিচালনা করেন সেকান্দার শাহ ১৩৫৭ সাল থেকে ১৩৮৯ সাল পর্যন্ত। সেকান্দারী গজ নামক একটি নির্দিষ্ট পরিমাপকের মাধ্যমে এই জরিপ চালানো হয়। তিনি জমির উৎপাদিত ফসলের চার ভাগের এক ভাগ রাজস্ব ধার্য্য করেছিলেন। সম্রাট শের শাহ্ ১৫৪০-১৫৪৫ সাল পর্যন্ত ভূমি জরিপ করেন। এটি ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য ভূমি জরিপ। এ সময় পাট্টা ও কবুলিয়ত প্রথার প্রবর্তন হয়। সম্রাট আকবরের আমলে তার অর্থমন্ত্রী টোডরমল জরিপ কাজ করেন। ভূমির দখলদারদের নিকট হতে তখন উৎপাদিত ফসলের তিন ভাগের একভাগ রাজস্ব আদায় করা হতো।  সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে মুর্শিদকুলি খাঁ বাংলার সুবেদার ছিলেন। তার আমলে এ অঞ্চলে জামা-ই-তামিল-তুমার নামে একটি জরিপ পরিচালিত হয়। এ জরিপে বাংলাকে ১৩টি চাকলা এবং ১৬৬০টি পরগনায় বিভক্ত করা হয়।

ইংরেজ আমল: ১৭৬৩-১৭৮২ সালে নকশাবিদ মেজর জন রেনেল শৃংখলাবদ্ধ পদ্ধতিতে জরিপ কাজ করেন। তিনি জরিপের মাধ্যমে  নকশা প্রস্তত করেন। ১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বার্ষিক ২৬ লক্ষ টাকার বিনিময়ে দিল্লির সম্রাট শাহ আলমের নিকট থেকে এদেশের ভূমি রাজস্ব আদায়ের কর্তৃত্ব লাভ করেন। তখন নায়েবগণের মাধমে রাজস্ব আদায় করা হতো। ১৭৬৯-১৭৭০ সাল (বাংলা ১১৭৬ সাল) এদেশে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হয়। দুর্ভিক্ষে এদেশের এক-তৃতীয়াংশ লোক মারা যায়। ১৭৭২ সালে ওয়ারেন্ট হেষ্টিংস পাঁচশালা বন্দোবস্ত চালু করেন। ১৭৯০ সালে লর্ড কর্ণওয়ালিশ দশশালা বন্দোবস্ত চালু করেন। ১৭৯৩ সালে তিনি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু করেন। ফলে মধ্যস্বত্বভোগী ও জমিদার শ্রেণীর সৃষ্টি হয় এবং গণঅসন্তোষ দেখা দেয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৮৫৯ সালে রেন্ট এ্যাক্ট পাশ করা হয় এবং জমিদার ও প্রজাদের মধ্যে সম্পর্কের উন্নয়নের চেষ্টা করা হয়।

১৮৭৯ সালে রেন্ট কমিশন গঠন করা হয়। তার পরিপ্রেক্ষিতে ১৮৮৫ সালে বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন পাশ করা হয়। এর ফলে কৃষকদের অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়। প্রজাদের অধিকার সম্বলিত খতিয়ান প্রণয়ন করা হয়। এ আইনকে রায়তদের মেগনাকার্টা বলা হয়। এ আইনের মাধ্যমে ক্যাডাস্ট্রাল সার্ভে শুরু হয়। ১৯৩৮ সালে জমিদারী প্রথা বিলোপ করে জন ফ্লাউড কমিশন গঠন করা হয়।

১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগ ও ইংরেজদের বিদায়ের পর ১৯৫০ সালের ১৬ মে রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন পাশ হয়। উক্ত আইনে রাষ্ট্রের সকল ভূমি জমিদারদের নিকট থেকে সরকার কর্তৃত্ব গ্রহণ করে প্রজাদের সম্পত্তির মালিকানা করে প্রজাদের স্বত্ব প্রতিষ্ঠিত করা হয়। তবে জমিদারদের নিকট থেকে ভূমি অধিগ্রহণ করতে সরকারকে নির্ধারিত টাকা প্রদান করতে হয়। এ সময় একজন জমিদারকে সর্বোচ্চ ৩৭৫ বিঘা সম্পত্তি ব্যতিরেকে সমস্থ সম্পত্তি সরকারের অনুকূলে ফেরৎ দিতে হয়। ১৯৫৬ সাল থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত যে জরিপ হয় তাকে স্টেট এ্যাকুইজেশন সার্ভে, সংক্ষেপে এস.এ সার্ভে বলা হয়। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একক ব্যক্তির অনুকূলে সর্বোচ্চ ১০০ বিঘা সম্পত্তি রাখা যাবে বলে বিধান চালু করেন। পরবর্তীতে ১৯৮৪ সালে রাষ্ট্রপতি হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদ এর শাসনামলে একক ব্যক্তির অনুকূলে সর্বোচ্চ ৬০ বিঘা সম্পত্তি রাখার বিধান চালু করেন। যা বর্তমানেও চালু আছে। রিভিশনাল সার্ভেকে সংক্ষেপে আর.এস এবং ডিস্ট্রিক্ট সার্ভেকে সংক্ষেপে ডি.এস বলা হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *