প্রচ্ছদ

উত্তাপ বাড়াচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেন ।। লাগতে পারে ‘পানি যুদ্ধ’

ডেস্ক রিপোর্ট, ধূমকেতু বাংলা: রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধ পরিস্থিতি ক্রমেই অবনতি হচ্ছে। যে কোনো মুহূর্তে বেজে উঠতে পারে রণডঙ্কা। সীমান্তে অস্ত্রের ঝঙ্কার শোনা যাচ্ছে। এই ঝঙ্কার বন্ধে হুঙ্কার দিচ্ছেন বাইডেন। তার সুরে সুর মেলাচ্ছেন ইউরোপের নেতারা। তাতে উত্তাপ ছড়াচ্ছে বিশ্বজুড়ে।

বড় প্রশ্ন, আসলে পুতিন কী চাচ্ছেন। ইউক্রেন দখল বা ন্যাটোকে নাকের ডগা থেকে দূরে রাখা? তা মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। তবে আপাতত তার চাই পানি। মিষ্টি পানি। এ জন্য তিনি একটি ‘ছোট যুদ্ধ’ অনিবার্য করে তুলতে পারেন।

ইউক্রেন-রাশিয়ার সাম্প্রতিক বিরোধের তিনটি দিক পশ্চিমা গণমাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে। এক. রাশিয়া আগ্রাসী রাষ্ট্র, তারা সার্বভৌম ইউক্রেন দখল করতে চায়। দুই. ইউক্রেনকে ন্যাটো থেকে দূরে রাখতে চায় রাশিয়া এবং তারা সীমান্তবর্তী দেশগুলোতে ন্যাটোর বৈধ উপস্থিতি আটকাতে চায়। তিন. কৃষ্ণসাগরে রাশিয়া একক মাতব্বরি করছে, যা অন্যায্য।

পশ্চিমা গণমাধ্যমের খবর, মন্তব্যগুলো পর্যালোচনা করলে দাঁড়ায়- রাশিয়া একটি গোঁয়ার রাষ্ট্র। ভেঙে যাওয়া সোভিয়েত সাম্রাজ্যের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারে আগ্রাসী হয়ে উঠেছেন পুতিন। তাকে থামানোর জন্য ইউরোপীয় মিত্রদের নিয়ে গণতান্ত্রিক বিশ্বের নেতা যুক্তরাষ্ট্র বহুদূর পর্যন্ত যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে রাশিয়ার ওপর চরম পর্যায়ের নিষেধাজ্ঞা, ইউক্রেন ও গণতন্ত্রকে রক্ষায় অস্ত্র দেওয়া, প্রয়োজনে ন্যাটোকে ব্যবহার- এসবই তাদের দৃষ্টিতে বৈধ হস্তক্ষেপ হবে।

সাম্প্রতিক ভিডিও বৈঠকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভদ্মাদিমির পুতিনকে সম্ভাব্য ইউক্রেন যুদ্ধের পরিণতি সম্পর্কে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এসব হুমকিতে পুতিন কি লেজ গুটিয়ে নিচ্ছেন? যদি ধরে নেওয়া যায়, ১০টি দিক থেকে এর উত্তর আছে ‘হ্যাঁ’, তাহলে ১১ নম্বর দিক থেকে একেবারেই ‘না’।

কী সেই ‘না’? উত্তর আছে ২০১৪ সালের ক্রিমিয়া সংকটের মধ্যে। ওই বছর ‘পুঁচকে’ ইউক্রেনের কাছ থেকে রক্তপাতহীন সামরিক অভিযানের মাধ্যমে ক্রিমিয়া দখল করে রাশিয়া। ক্রিমিয়া একটি উপত্যকা।

এর তিন দিকে কৃষ্ণসাগর ও একদিকে আজভ সাগর। এ দুই সাগরে একক আধিপত্য ধরে রাখতে সুযোগ বুঝে চিলের মতো ছোঁ মেরে ক্রিমিয়া ছিনিয়ে নেয় রাশিয়া।

১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যে ১৫টি দেশের জন্ম হয়, তার একটি ইউক্রেন। দেশটিকে নম্র-ভদ্র অজ্ঞাবহ ছোট ভাইয়ের মতো দেখতে চায় রাশিয়া। দুই দেশের মধ্যে ভাষা ও সংস্কৃতির বেশ মিল রয়েছে। তবে ইউক্রেনে জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্রের বিকাশ হয়েছে। দেশটির জনগণ ক্রিমিয়া ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনাকে বড় ভাইয়ের পেছন থেকে ছুরি মারার অভিজ্ঞতা হিসেবে নিয়েছে। তাৎক্ষণিক প্রতিশোধ হিসেবে ইউক্রেন সরকার নর্থ ক্রিমিয়ান ক্যানেলে (উত্তর ক্রিমিয়ান খাল) বাঁধ দিয়ে ক্রিমিয়ায় পানির জোগান বন্ধ করে দেয়।

চারদিকে সাগরের নোনাপানি ঘেরা ক্রিমিয়ার ৯০ শতাংশ মিষ্টি পানির চাহিদা পূরণ করে ইউক্রেনের দিনিপার নদী থেকে আসা খাল। গত সাত বছরে এই খাল দিয়ে কোনো পানি আসেনি। চাষাবাদ, শিল্প, গৃহকাজ মুখ থুবড়ে পড়েছে। শুকিয়ে যাওয়া লবণাক্ত উসর মাটিতে ফলছে না ফসল। গভীর নলকূপ ও বাইরে থেকে পাইপ দিয়ে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে।

জনজীবন ও উৎপাদন ব্যবস্থা সচল রাখতে পুরো কৃত্রিমভাবে পানির চাহিদা মেটাতে রাশিয়াকে গত সাত বছরে প্রায় ট্রিলিয়ন ডলার গচ্চা দিতে হয়েছে। এর চেয়ে দিনিপার নদী দখল ও খালের বাঁধ খুলে দেওয়ার জন্য একটি যুদ্ধ করা পুতিনের জন্য সহজ। তার আগে ইউক্রেনকে হুমকি-ধমকি দেওয়ার সহজ পথটিও পরখ করে দেখছে মস্কো। তবে তাতে কাজ হচ্ছে না। ইউক্রেনের পরিবেশমন্ত্রী মিখাইলো বলেছেন, ক্রিমিয়া ফিরিয়ে না দিলে খালের বাঁধ সরানো হবে না। এ নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কথা তুলেছে রাশিয়া। তবে এই ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের কূটনীতিকরা ইউক্রেনের অবস্থানকে সমর্থন করে যাচ্ছেন। মস্কোর খাল খুলে দেওয়ার দাবিকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক টানাপোড়েনকে তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহার করে ন্যাটোর সদস্য হওয়ার পটভূমি তৈরি করেছে ইউক্রেন। পশ্চিমা গণমাধ্যম সচেতনভাবেই এই পটভূমিকে এড়িয়ে গিয়ে শুধু রাশিয়াকে আগ্রাসী দেখানোতেই ব্যস্ত। ফলে পানির কারণেই যে ইউক্রেন-রাশিয়ার রাজনীতি যুদ্ধের ময়দানে গড়ানোর উপক্রম হচ্ছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু দৃষ্টি ঘুরিয়ে গণমাধ্যমের রমরমা খবরে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সামরিক ও অর্থনৈতিক উত্তেজনা তৈরি করা হয়েছে।

ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের তিনটি এলাকা- লুহানস্ক, দোনেৎস্ক ও দোনবাস। ছয়-সাত বছর ধরে রুশভাষী অধ্যুষিত এসব এলাকায় বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন চলছে। কিয়েভের অভিযোগ, রাশিয়ার উস্কানিতে এসব হচ্ছে। রাশিয়া অস্বীকার করলেও বাস্তবতা তাই। খালের পানির জন্য প্রয়োজনে ওই তিনটি এলাকাও মস্কো ছিনিয়ে নিলে তা প্রতিরোধ করার কতটা সামর্থ্য আছে ইউক্রেনের? সম্ভাব্য এই বিপর্যয় এড়াতে যুক্তরাষ্ট্রের শরণাপন্ন হয়েছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভালোদিমির জেলোনস্কি। ওয়াশিংটনেরও যে স্বার্থ নেই, তা নয়। তাদের আছে আধিপত্যের স্বার্থ। ইউরোপেরও তাই। ফলে স্থানীয় পানি সংকট থেকে একটি সম্ভাব্য যুদ্ধের আন্তর্জাতিকীকরণ দেখা যাচ্ছে।

পুতিনের সঙ্গে বৈঠকের পর বাইডেন ইউক্রেন ও ইউরোপের মিত্রদের রাশিয়ার ‘রেড লাইনসের’ বিষয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন, যাতে যুদ্ধ এড়িয়ে একটি কূটনৈতিক সমাধানে আসা যায়। রাশিয়ার চাওয়াগুলোই ‘রেড লাইনস’। এগুলো পূরণে আগ্রহী নয় ইউক্রেন। তাদের ক্রিমিয়া ফেরত চাই। রাশিয়ার চাই পানি। এ ক্ষেত্রে শেষ পর্যন্ত যদি কোনো সমাধান সূত্র বের না হয়, তাহলে সীমান্তে মোতায়েন রাশিয়ার সৈন্যরা খালি হাতে ফিরবেন বলে মনে হয় না। কারণ, গতকালও পুতিন কড়া বার্তা দিয়েছেন। দোনবাসের সরকারি বাহিনীর হাতে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মৃত্যুর ঘটনাকে ‘গণহত্যা’ বলে অভিহিত করে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার হুঙ্কার দিয়েছেন তিনি।

তবে একটি বিষয় আপাতত পরিস্কার, রাশিয়া হামলা চালালেও তা হবে ছোট পরিসরে। আফগান ও ইরাক যুদ্ধের অভিজ্ঞতা এবং করোনা মহামারিতে বিপর্যস্ত বিশ্বে আরেকটি বড় যুদ্ধে জড়ানোর সুযোগ বা ইচ্ছা এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের না থাকারই কথা। তারা না এগোলে ইউরোপও পা বাড়াবে না। ফলে একটি খণ্ডযুদ্ধ বা আগ্রাসনের দিকে এগোচ্ছে ইউক্রেন পরিস্থিতি। যা শুরু হয়েছিল পানির জন্য, তার শেষ হতে পারে বিশাল ধ্বংসযজ্ঞের মধ্য দিয়ে। সূত্র :ব্লুমবার্গ, আলজাজিরা, ইউক্রিনফর্ম, বিবিসি, মস্কো টাইমস, রেডিও ফ্রি ইউরোপ।

আরো পড়ুন:

আন্তর্জাতিক দাতাগোষ্ঠী আফগানিস্তান সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্য ও খাদ্য তহবিলে ছাড় দিবে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *