স্বাস্থ্য

উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে ঠেকানো যায় অনেক জটিল রোগ

নিখিল মানখিন, ধূমকেতু ডটকম: উচ্চ রক্তচাপ বিশ্বব্যাপী নীরব ঘাতক হিসেবে চিহ্নিত। উচ্চ রক্তচাপে হার্ট এ্যাটাক, ব্রেন এ্যাটাক, হৃদরোগ, কিডনি বিকল এবং অন্ধত্ব বরণের  শিকার হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে উচ্চ রক্তচাপজনিত হৃদরোগ ও স্ট্রোকের প্রকোপ বেড়ে চলেছে। দেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ২ দশমিক ৫ ভাগ হৃদরোগে এবং ২ ভাগ স্ট্রোকে আক্রান্ত। এসব রোগের চিকিৎসা খুবই ব্যয়বহুল ও জটিল। তাই যে কোনো উপায়ে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখার ওপর জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা জানান, স্বাভাবিক রক্তচাপ হল সেই বল, যার সাহায্যে রক্ত শরীরের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পৌঁছায়। রক্তচাপের কোনো একক নির্দিষ্ট মাত্রা নেই। বিভিন্ন বয়সের সঙ্গে সঙ্গে একেকজন মানুষের শরীরে রক্তচাপের মাত্রা ভিন্ন এবং একই মানুষের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময়ে স্বাভাবিক এ রক্তচাপও বিভিন্ন রকম হতে পারে। উত্তেজনা, দুশ্চিন্তা, অধিক পরিশ্রম ও ব্যায়ামের ফলে রক্তচাপ বাড়তে পারে। ঘুমের সময় এবং বিশ্রাম নিলে রক্তচাপ কমে যায়। রক্তচাপের এ পরিবর্তন স্বাভাবিক নিয়মের মধ্যে পড়ে। অধিকাংশ সময় রক্তচাপটা স্বাভাবিক মাত্রার ভেতরই থাকে। সাধারণত বয়স যত কম, রক্তচাপও তত কম হয়। যদি কারো রক্তচাপ স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেশি হয় এবং অধিকাংশ সময় এমনকি বিশ্রামকালীনও বেশি থাকে, তবে ধরে নিতে হবে, তিনি উচ্চ রক্তচাপের রোগী।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডীন, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ ধূমকেতু ডটকমকে বলেন, উচ্চ রক্তচাপ ভয়ংকর পরিণতি ডেকে আনতে পারে। অনেক সময় উচ্চ রক্তচাপের কোনো প্রাথমিক লক্ষণ দেখা যায় না। নীরবে উচ্চ রক্তচাপ শরীরের বিভিন্ন অংশকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এ জন্যই উচ্চ রক্তচাপকে ‘নীরব ঘাতক’ বলা যেতে পারে। অনিয়ন্ত্রিত এবং চিকিৎসাবিহীন উচ্চ রক্তচাপ থেকে মারাত্মক শারীরিক জটিলতা দেখা দিতে পারে। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রিত না থাকলে শরীরের গুরুত্বপূর্ণ চারটি অঙ্গে মারাত্মক ধরনের জটিলতা হতে পারে। যেমন- হৃৎপিণ্ড, কিডনি, মস্তিষ্ক ও চোখ।

ডা. আব্দুল্লাহ বলেন, ৯০ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে উচ্চ রক্তচাপের কোনো নির্দিষ্ট কারণ জানা যায় না, একে প্রাইমারি বা এ্যাসেন্সিয়াল রক্তচাপ বলে। কিছু কিছু বিষয় উচ্চ রক্তচাপের আশংকা বাড়ায়। যেমন – বংশানুক্রমিক, ধূমপান, অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ, অধিক ওজন এবং অলস জীবনযাত্রা, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভাস, অতিরিক্ত মদ পান, ডায়াবেটিস, অতিরিক্ত উৎকণ্ঠা ইত্যাদি। অতিরিক্ত রাগ, উত্তেজনা, ভীতি এবং মানসিক চাপের কারণেও রক্তচাপ সাময়িকভাবে বেড়ে যেতে পারে। কিছু কিছু রোগের কারণে উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে। নির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাওয়া গেলে একে বলা হয় সেকেন্ডারি হাইপারটেনশন। এ কারণগুলোর মধ্যে কয়েকটি হল- কিডনির রোগ, অ্যাড্রেনাল গ্রন্থি ও পিটুইটারি গ্রন্থির টিউমার, ধমনীর বংশগত রোগ, গর্ভধারণ অবস্থায় অ্যাকলাম্পসিয়া ও প্রি-অ্যাকলাম্পসিয়া হলে, অনেক দিন ধরে জন্মনিয়ন্ত্রণের বড়ির ব্যবহার, স্টেরয়েড জাতীয় হরমোন গ্রহণ এবং ব্যথানাশক কিছু কিছু ওষুধ খেলে। কেউ কেউ এমনও ভাবেন যে উচ্চ রক্তচাপ তার দৈনন্দিন জীবনপ্রবাহে কোনো সমস্যা করছে না বা রোগের কোনো লক্ষণ নেই, তাই উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ খেতে চান না। এ ধারণাটাও সম্পূর্ণ ভুল। এ ধরনের রোগীরাই হঠাৎ হৃদরাগ বা স্ট্রোকে আক্রান্ত হন, এমনকি মৃত্যুও হয়ে থাকে।

অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, রক্তনালী বা ধমনীর দেয়ালের বিপরীতে রক্ত প্রবাহের ধাক্কাকেই রক্তচাপ বলে। রক্তচাপ খুব বেড়ে গেলে তা হৃদপিণ্ডের কাজ অস্বাভাবিক ভাবে বাড়িয়ে দেয় এবং রক্তনালীর মারাত্মক ক্ষতি করে। ১২০/৮০ এর অধিক রক্তচাপকে উচ্চ রক্তচাপ বলে। ওপরের মাত্রাটিকে সিস্টোলিক চাপ বলে, যা হৃদযন্ত্রের স্পন্দনের সময়কার রক্তচাপ। নীচের মাত্রাকে ডায়াস্টোলিক চাপ বলে, যা হৃদস্পন্দনের অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের রক্তচাপ যখন হৃদযন্ত্রে রক্ত এসে জমা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই উচ্চ রক্তচাপের কারণ জানা যায় না। উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশনকে নীরব ঘাতক বলা হয়।  বছরের পর বছর এটি উপসর্গহীন থাকতে পারে। প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজন জানে না যে, তাদের উচ্চ রক্তচাপ আছে। এটি হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, রক্তনালী, মস্তিষ্ক এমনকি কিডনিরও ক্ষতি করতে পারে, যদি এর চিকিৎসা না করা হয়। 

যাদের রক্তচাপ ক্রমাগতভাবে স্বাভাবিক মাত্রার সামান্য ওপরে থাকে; অর্থাৎ সিস্টোলিক মাত্রা ১২০ থেকে ১৩৯ এর মধ্যে এবং ডায়াস্টোলিক মাত্রা ৮০ থেকে ৮৯ এর মধ্যে থাকলে তাকে প্রি-হাইপারটেনশন বলে। এদের উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন হবার ঝুঁকি অনেক বেশি। চিকিৎসকেরা তাদেরকে জীবনযাত্রায় পরিবর্তন এনে রক্তচাপ কমানোর পরামর্শ দিয়ে থাকেন। গড়ে রক্তচাপ ১৪০/৯০ বা এর ওপরে থাকলে কোনও উপসর্গ না থাকলেও ধরে নিতে হবে, আপনি রক্তচাপে ভুগছেন। রক্তচাপ ১৮০/১১০ বা এর ওপরে হলে তা উচ্চ রক্তচাপের বিপজ্জনক পর্যায়, অস্থির না হয়ে এ অবস্থায় কয়েক মিনিট বিশ্রাম নিয়ে আবার রক্তচাপ মাপুন। এর পরও রক্তচাপ বেশি থাকলে দ্রুত হাসপাতালে যাবার জন্য অ্যাম্বুলেন্স ডাকুন। এই অবস্থা থেকে হার্ট এ্যাটাক, কিডনি ফেইলিয়র, জ্ঞান হারানোর  মতো মারাত্মক কিছু হয়ে যেতে পারে। এছাড়াও অসহ্য মাথাব্যথা, বুক ধড়ফড় করা, নাক দিয়ে রক্তপাত, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দিতে পারে বলে জানান অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ।

উচ্চ রক্তচাপের কারণে কিডনি বিকল হয়ে যেতে পারেন। এমন কথা বলেছেন বাংলাদেশ রেনাল এসোসিয়েশনের মহাসচিব এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের  নেফ্রোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা: শহিদুল ইসলাম সেলিম। তিনি ধূমকেতু ডটকমকে জানান,  কিডনি অকেজো হয় বিভিন্ন কারণে। এর মধ্যে দ্বিতীয় কারণে হিসাবে কাজ করে উচ্চ রক্তচাপ। উচ্চ রক্তচাপ ও কিডনি সমস্যা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। উচ্চ রক্তচাপ সৃষ্টি হলে কিডনি সমস্যা বেড়ে যায় এবং কিডনি সমস্যা হলেও বেড়ে যায় উচ্চ রক্তচাপ। তাই যে কোনও ভাবে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে হবে। এদের মধ্যে কারো কারো কিডনি হঠাৎ করে অকেজো হয়ে যায়।

জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল পরিচালক হাসপাতালের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. আব্দুল্লাহ আল সাফী মজুমদার ধূমকেতু ডটকমকে জানান, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী হাসপাতালের সেবা প্রাপ্তদের শতকরা ১৫ দশমিক ৫৬ ভাগ উচ্চরক্তচাপের রোগী। ৪০ থেকে ৪৯ বছর বয়সের রোগীরাই অধিক হারে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ে হাসপাতালে আসেন। ১৯ বছরের নীচে শিশু কিশোরদের মধ্যেও ইদানিং উল্লেখযোগ্য হারে উচ্চ রক্তচাপ পরিলক্ষিত হচ্ছে। শিশু কিশোরদের উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্তের প্রধান কারণ হলো পরিবর্তিত জীবনাচরণ অর্থাৎ অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভাস এবং স্থুলতা। এছাড়াও তাদের উচ্চ রক্তচাপের জন্য পারিবারিক ইতিহাস, ডায়াবেটিস, কিডনির রোগও কম দায়ী নয়। সারাবিশ্বে প্রায় দেড়শ’ কোটি লোক উচ্চ রক্তচাপের শিকার এবং  প্রতি বছর এ রোগে  মারা যায়  প্রায় ৭০ লাখ মানুষ।  বিশ্বব্যাপী এ রোগীটিকে নীরব ঘাতক হিসাবে চিহিৃত করা হয়েছে বলে জানান অধ্যাপক ডা. আব্দুল্লাহ আল সাফী মজুমদার।

আইসিডিডিআর’বি এর গবেষণা প্রতিবেদনে  বলা হয়,  তুলনামূলকভাবে বেশি বয়সী, অধিক শিক্ষিত এবং ধনীদের মধ্যেই সাধারণত উচ্চ রক্তচাপের প্রবণতা বেশি দেয়া যায়। উচ্চ রক্তচাপের সন্তোষজনক  ব্যবস্থাপনা উচ্চ রক্তচাপের কারণে সৃষ্ট জটিলতা এবং মৃত্যুর মতো অনাকাঙ্খিত ঘটনা কমিয়ে আনতে পারে। হৃদরোগ সৃষ্টি, স্ট্রোক এবং কিডনি অকার্যকর করার পেছনে উচ্চ রক্তচাপ একটি বড় ধরনের ঝুকি। বাংলাদেশের শহর ও গ্রামের কিছু সার্ভিলেন্স এলাকায় উচ্চ রক্তচাপের ওপর গবেষণা করে আইসিডিডিআর’বি এর বিজ্ঞানীরা। দেশে উচ্চ রক্তচাপ নির্ণয় এবং ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত তথ্য খুব কম পাওয়া যায়। গ্রামাঞ্চলে প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রিবিহীন সেবাপ্রদানকারী বা চিকিৎসকরা উচ্চ রক্তচাপ নির্ণয়ে একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে থাকেন। গ্রামাঞ্চলের বেশিরভাগ গরীব মানুষকে মানসম্মত চিকিৎসা প্রদানের জন্য উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসায় গ্রাম ডাক্তারদের দক্ষতা বাড়ানো দরকার বলে গবেষণায় বলা হয়েছে।

আরো পড়ুন:

হৃদরোগ থেকে বাঁচার ১১ উপায় : ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *