ধর্ম ও জীবন ডেস্ক, সুখবর ডটকম: সাকার মানে যার আকার বা রূপ আছে এবং নিরাকার মানে যার আকার বা রূপ নেই। এই সাকার নিরাকারের মূল রহস্য জানতে হলে প্রথমে বুঝতে হবে ভগবান এবং ঈশ্বরের মধ্যে পার্থক্যটা আসলে কী ?

যশ, বীর্য, ঐশ্বর্য, শ্রী, জ্ঞান, বৈরাগ্য- এই ছয়টি গুণকে বলে ভগ, আর যার মধ্যে এই ছয়টি গুণ থাকে, পুংলিঙ্গে তাকে বলে ভগবান এবং স্ত্রীলিঙ্গে ভগবতী; কিন্তু সকল গুণ যার মধ্যে থাকে তাকে বলে ঈশ্বর । যিনি ঈশ্বর, তিনি ভগবান হতে পারেন; কিন্তু যিনি শুধু ভগবান, তিনি ঈশ্বর নন।

কারণ, যার মধ্যে সকল গুণ থাকে, তার মধ্যে উল্লেখিত ছয়টি গুণ অবশ্যই থাকবে, তাই তিনি একই সাথে ঈশ্বর এবং ভগবান; কিন্তু যার মধ্যে শুধু ছয়টি গুণ থাকে, তিনি কেবল ভগবান, সকল গুণ না থাকায় তিনি ঈশ্বর হতে পারেন না।

হিন্দুশাস্ত্রে বর্ণিত সকল দেব-দেবী ঈশ্বরের বিশেষ গুণ বা ক্ষমতা বিশিষ্ট সত্ত্বা, এঁদের আকার আছে, এঁরা ভগবান বা ভগবতী, এই সূত্রে সকল দেবতা ভগবান এবং সকল দেবী ভগবতী, কিন্তু তারা কেউ ঈশ্বর নন, যদিও তাঁরা ঈশ্বরের বিভিন্ন কার্যকরী শক্তি।

হিন্দুশাস্ত্রমতে ভগবান বা ভগবতীরা সৃষ্টিকর্তা নন, সৃষ্টিকর্তা হলেন ঈশ্বর, যাকে ব্রহ্ম বা পরমব্রহ্মও বলা হয়, এই ঈশ্বর সম্পর্কে শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের চতুর্থ অধ্যায়ের ১৯নং শ্লোকে বলা আছে,

“ন তস্য প্রতিমা অস্তি”

অর্থাৎ “তাঁর কোনো উপমা বা সদৃশ নেই” । একই কথা বলা আছে, শুক্লযজুর্বেদ এর ৩২নং অধ্যায়ের ৩নং মন্ত্রে । এই মন্ত্রের অর্থ হিসেবে- কোলকাতার হরফ প্রকাশনী, যার মালিক একজন মুসলমান, তার প্রকাশিত বেদ এ বলা আছে-

“এ পুরুষের তুলনা দেবার কোনো বস্তু নেই । তার মহৎ যশ আছে।”

বেদ ও উপনিষদের এই থিয়োরি মেনে হিন্দুরা, পরমব্রহ্ম বা ঈশ্বরের কোনো মূর্তি তৈরি করে নি, বাস্তবেও হিন্দুধর্ম বা হিন্দু সমাজে পরমব্রহ্ম বা ঈশ্বরের কোনো মূর্তি নেই; কারণ, ঈশ্বর নিরাকার।

তাহলে যাদের মূর্তি বা প্রতিমা আছে, তারা আসলে কে? এরা হলেন ঈশ্বরের বিভিন্ন শক্তি বা গুণের প্রকাশক দেব-দেবী, যে কথা একটু আগেও বলেছি, এরাই আসলে ভগবান বা ভগবতী।

এককথায়, যাদের আকার বা মূর্তি আছে তারা ভগবান বা ভগবতী, আর যার আকার নেই, নিরাকার, তিনি ঈশ্বর। ঈশ্বরের বিভিন্ন শক্তির প্রকাশক দেব-দেবীরা ছাড়াও, শ্রীকৃষ্ণ ব্যতীত যারা ঈশ্বরের অবতার, তারাও ভগবান; কারণ, শ্রীকৃষ্ণ ছাড়া ঈশ্বরের অন্যান্য অবতারগণের মধ্যে ঈশ্বরের পূর্ণশক্তি ছিলো না, একারণেই- রাম, পরশুরাম, বলরাম- ভগবান, ঈশ্বর নয়।

পরমব্রহ্ম বা ঈশ্বর নিরাকার, কিন্তু তিনি যখন অবতার রূপ ধারণ করে পৃথিবীতে আসেন, তখনই তিনি সাকার, এই কথার শাস্ত্রীয় প্রমাণ আছে গীতার ৪র্থ অধ্যায়ের ৬, ৭ ও ৮ নং শ্লোকে, যেখানে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন,

“অজোহপি সন্নব্যয়াত্মা ভূতানামীশ্বোরহপি সন্।

প্রকৃতিং স্বামধিষ্ঠায় সম্ভবাম্যাত্মমায়য়া।।”- (গীতা, ৪/৬)

এর অর্থ – যদিও আমি জন্মরহিত এবং আমার চিন্ময়দেহ অব্যয় এবং যদিও আমি সর্বভূতের ঈশ্বর, তবুও আমার অন্তরঙ্গা শক্তিকে আশ্রয় করে আমি আমার আদি চিন্ময়রূপে যুগে যুগে অবতীর্ণ হই।

এরপর ৭ ও ৮ নং শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন,

যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।

অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্।।

পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম।

ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।।

এর অর্থ – যখনই ধর্মের অধঃপতন হয় এবং অধর্মের অভ্যুত্থান হয়, তখনই আমি নিজেকে প্রকাশ করে অবতীর্ণ হই, সাধুদের পরিত্রাণ করি, দুষ্কৃতকারীদের বিনাশ করি এবং ধর্মকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করি।

গীতার এই তিনটি শ্লোকে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, ঈশ্বর পৃথিবীতে অবতীর্ণ হন, তো ঈশ্বর যখন পৃথিবীতে অবতীর্ণ হন, তখন তো তিনি কোনো না কোনো দেহ ধারণ করেই আসেন, তাই ঈশ্বর যখন কোনো দেহ ধারণ করেন, তখন তিনি সাকার; আর যখন তিনি দেহ ধারণ করেন না, তখন তিনি নিরাকার।

সুতরাং ঈশ্বর, সাকার বা নিরাকার দুটোই হতে পারেন; কিন্তু ঈশ্বরের কার্যকরী রূপ ভগবান সবসময়ই সাকার, তাই তাদের আকার রূপ মূর্তি নির্মাণ করে আমরা তাদের মাধ্যমে পরমব্রহ্ম ঈশ্বরের কাছে পূজা প্রার্থনা করি, যেহেতু তারা ঈশ্বরেরই বিভিন্ন রূপ।

সূত্র: হিন্দুডাটা

এসি/

আরো পড়ুন:

মহাভারতের সবচেয়ে শক্তিশালী যোদ্ধাগণ

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *