নিজস্ব প্রতিবেদক, ধূমকেতু ডটকমঃ আমিরন খাতুনের জীর্ণ ঘরের পাশ দিয়ে চলে গেছে বৈদ্যুতিক লাইন। প্রতিবেশীদের বাড়িতে জ্বলে বৈদ্যুতিক আলো। দারিদ্র্যের কষাঘাতে নিষ্পেষিত ৯৩ বছর বয়সী আমিরনের ভাগ্যে জোটেনি বৈদ্যুতিক বাতির সুবিধা। এ বাড়ি ও বাড়ি থেকে পাওয়া সাহায্যে তার আহারের ব্যবস্থা হয়। তবে এ নিয়ে আমিরন খাতুনের কোনো আক্ষেপ নেই। এতটা দীর্ঘ জীবনে তার অনেক আশাই পূরণ হয়নি। তবে তার একটি আশা পূরণ হয়েছে বলে তিনি খুশি। খুশির কারণ তিনি জীবন সায়াহ্নে এসে বাংলা বর্ণমালা শিখতে পেরেছেন। ছোটদের বই হাতে তার লেখাপড়া চলছে।
পাবনা জেলা শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে আটঘরিয়া উপজেলার গোপালপুর গ্রামের মৃত রহমান মোল্লার স্ত্রী আমিরন খাতুন। জন্ম সনদ অনুযায়ী তার বয়স ৯৩ বছর। তিনি আটঘরিয়া উপজেলার গোপালপুর গ্রামের মৃত খবির উদ্দিন প্রামাণিকের মেয়ে। তার গ্রামের তাঁতীপাড়া ইয়াং স্টার নামের একটি সংগঠনের কিছু শিক্ষিত যুবক তাকে অক্ষরজ্ঞান দান করেছেন।
এ বয়সে এসেও লেখাপড়ার প্রতি কেন আগ্রহ জন্মালো, এমন প্রশ্নে আমিরন খাতুন বলেন, গ্রামের ছোট্ট শিশুদের স্কুলে যাওয়া-আসা তিনি প্রতিদিন দেখেন। তাদের দেখেই তার লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়।
গোপালপুর তাঁতীপাড়া ইয়াং স্টার ক্লাবের সদস্য মুরাদ হোসেন বলেন, আমিরন খাতুনের জীবনের কোনো আশাই বলতে গেলে পূরণ হয়নি। তিনি তাদের কাছে পড়ালেখা করার ইচ্ছার কথা জানিয়েছিলেন। তার সে ইচ্ছা পূরণ করার জন্য তিনিসহ ক্লাবের কয়েকজন সদস্য এগিয়ে আসেন। তাকে অন্তত অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন করে তোলার চেষ্টা করেন। এরইমধ্যে তারা সফলও হয়েছেন।
মুরাদ হোসেন বলেন, ‘ওই বুড়ি মা এখন বাংলা অক্ষর চেনেন ও মুখস্থ করতে পেরেছেন। এতে আমরা খুশি। এখন পড়াটা ঠিক হয়ে গেলেই তিনি ধর্মীয় বইপত্র পড়তে পারবেন বলে আশা করা যায়।’
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, ছোট্ট একটি ভাঙা ঘরে থাকেন বৃদ্ধা আমিরন খাতুন। বৃষ্টি হলেই চাল চুয়ে পানি পড়ে। স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ। এ পরিবেশে থাকতে থাকতে তার হাত-পায়ে ঘা হয়ে গেছে। নিয়মিত খাবার না পাওয়া আর অসুখ-বিসুখে তিনি জর্জরিত। চিকিৎসা করানোর মতো সামর্থ্য নেই। তবে এ বয়সেও ভালোভাবে চলাফেরা করতে পারেন তিনি।
১৭ বছর আগে স্বামীকে হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়েন এ বৃদ্ধা। তার দুই ছেলে রয়েছে। তবুও একমুঠো ভাতের জন্য অন্যের কাছে হাত পাততে হয়। অনেকটা আক্ষেপের সুরে আমিরন খাতুন বলেন, তারাই (দুই ছেলে) ঠিকমতো ভাত পায় না। আমাকে খাওয়াবে কিভাবে? থাকার জন্য একটি ঘর দাবি করেন এ বৃদ্ধা।
আমিরন খাতুনের স্বজন জয়নব খাতুন বলেন, ছেলেমেয়েরা হতদরিদ্র হওয়ার কারণে আমিরন খাতুনের জীবন দুর্দিন নেমে এসেছে। তিনি বাধ্য হয়ে পরের দুয়ারে হাত পাতেন।
স্থানীয় বাসিন্দা কামাল সরকার বলেন, তিন মাস ছয় মাস পর পর আমিরন খাতুন বিধবা ভাতার কিছু টাকা পান। ওই সামান্য টাকায় তো এক সপ্তাহও চলে না। সে টাকা দিয়ে তিনি কী খাবেন আর কী চিকিৎসা করাবেন? মানবেতর জীবনযাপন করছেন এ বৃদ্ধা।
তাঁতীপাড়া ইয়াং স্টার ক্লাবের সভাপতি হারুন প্রাং বলেন, টিনের তৈরি ছোট্ট একটি ভাঙা ঘরে মানবেতর জীবনযাপন করছেন বৃদ্ধা আমিরন। তাদের ক্লাবের পক্ষ থেকে সামান্য কিছু সহযোগিতা করা হয়েছে। তবে দেশের দানশীল কিছু মানুষ শিক্ষানুরাগী এ বৃদ্ধার জন্য হাত বাড়ালে তার জন্য একটি ভালো ঘর করে দেওয়া সম্ভব।
পাবনা জেলা স্কুলের সিনিয়র শিক্ষক ফিরোজ হোসেন বলেন, অশীতিপর এ বৃদ্ধা হাজারো কষ্টের মধ্যে একটু পড়ালেখা করতে চেয়েছেন, এটা অনেক গৌরবের কথা। তবে তার কষ্টের জীবন যে কোনো মানুষকে ব্যথিত করে। তার পাশে সবাই একটু সহযোগিতার হাত বাড়ালে তিনি জীবনের বাকি দিনগুলো শান্তিতে অতিবাহিত করতে পারেন।
আটঘরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাকসুদা আক্তার মাসু বলেন, এ বয়সে এসে আমিরন খাতুন অক্ষরজ্ঞান লাভ করেছেন, এটা অবশ্যই খুশির বিষয়। ‘নিরক্ষর থাকবো না’ বলে তার ভেতরের বোধ প্রশংসনীয়। উপজেলা প্রশাসন তার পাশে রয়েছে। তার বয়স্ক ভাতার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে এ টাকা চাহিদার তুলনায় অল্প। সরকারের পাশাপাশি দেশের দানশীল ব্যক্তিরা তাকে সাহায্য সহযোগিতা করলে তিনি একটু ভালোভাবে জীবনযাপন করতে পারবেন।
আরো পড়ুনঃ
তালের বীজ রোপণ করে চলেছেন একজন তাজ-উল ইসলাম