দিলারা জামান :
আমাদের যাপিত জীবনে সব সময়ই নতুন স্মৃতি এসে ভিড় করে। বিস্মৃতির অতলে আবার হারিয়ে যায় অনেক কিছু। তবে সবকিছু হারায় না। স্মৃতির পটে জীবনের অনেক ছবি অজান্তে আঁকা হয়ে যায়। সেটা শুধুই মনের ক্যানভাসের ছবি। ঠিক আমিও আমার অজান্তে দু’জন ব্যক্তির মুখ মনের পেনসিলে আঁকি। তারা আমার বাবা-মা; আমার জীবনে বিরাট ছায়া। নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসার মানুষ তারাই। ছেলেমেয়ের কৃতিত্ব দেখে বাবা-মা যেমন আনন্দিত হন, আবার খারাপ কিছু দেখলে কষ্ট পান। বাবা-মায়ের কাছে সন্তান সব সময় নিরাপদ। আমার মায়ের নাম সেতারা বেগম, বাবার নাম রফিক উদ্দিন আহমেদ। বাবা ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার; মা গৃহিণী। আমার জন্ম নোয়াখালীর এক রক্ষণশীল পরিবারে। মা বোরকা পরতেন। আমিও স্কুল-কলেজে বোরকা পরে যেতাম। সেই রকম রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে হয়েও তারা যে আমাকে সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত হওয়ায় কোনো বাধা দেননি; তাদের প্রতি আমার জীবনের এটা বড় প্রাপ্তি। তারা যদি মানুষের কথায় কাজে বাধা দিতেন, তাহলে এতদূর এগিয়ে যেতে পারতাম না। ধুলোমাখা শৈশব-কৈশোরের বেশিরভাগ সময় কেটেছে যশোরে। খেলার জায়গা বলতে ঘরের বারান্দা কিংবা পাশের বাড়ির আমতলা। বিকেলে খেলার মাঠ। ফিরে এসে মা-বাবার সান্নিধ্য। বাবাকে পেতাম সেই সন্ধ্যার পর।
অফিস থেকে ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরতেন তিনি। এখন পরিপ্রেক্ষিত বদলে গেছে। বাবা-মা সন্তানদের ইচ্ছা থাকলেও সময় দিতে পারেন না। জীবিকার জন্য তাদের বাইরে থাকতে হয়। ছোটবেলায় সারাদিন পর মা-বাবাই ছিলেন বড় আশ্রয়। তখন বৈদ্যুতিক পাখা ছিল না। মা হাতপাখা দিয়ে বাতাস করতেন। চাঁদনী রাতে বারান্দায় মাদুর বিছিয়ে গল্প করেছি। বাবার কণ্ঠ খুব সুন্দর ছিল। ‘আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ওই…’ গানটি বেশি গাইতেন তিনি। সেই কণ্ঠস্বর এখনও কানে বাজে। তাকে ভীষণ ভয়ও পেতাম। আমি অঙ্কে কাঁচা ছিলাম। বাবা যখন পড়া না পারলে ধমক দিতেন, অন্তরাত্মা কেঁপে উঠত। বড় হওয়ার পর বিয়ে হলো। আরেকজনের ঘরনি হলাম। আরেক রকম জীবন। সেখানে গিয়ে বাবা-মাকে পাশে পাওয়ার জন্য উদগ্রীব থাকতাম। এটা তো চিরন্তন সত্য- নিজের মেয়েকে দূরে সরিয়ে দিয়ে আরেকজনের মেয়েকে কাছে নিয়ে আসা হয়। বাবা-মা যখন মারা যান, তখন তাদের কাছে থাকতে পেরেছিলাম। এটাই আমার জীবনের বড় সান্ত্বনা। ১৯৫৮ সালে আমাদের বংশের মেয়েদের মধ্যে আমিই প্রথম ম্যাট্রিক পাস করি। সেই আনন্দে বাবাও খুব খুশি হয়েছিলেন। আমাদের বাসা ছিল লালবাগে। পাশেই আজাদ পত্রিকার অফিস। বাবা তখন সেই অফিস থেকে রেজাল্টের পত্রিকা ও মিষ্টি নিয়ে বাসায় এসেছিলেন। বাবা খুশি হয়েছিলেন। তখন তো রেডিও-টেলিভিশনে সরাসরি অনুষ্ঠান প্রচার হতো। বাসায় ফিরলে বাবা-মা আমার অভিনয়ের প্রশংসা করতেন।
ছোটবেলায় আমি খুব দুষ্টু ছিলাম। ১৯৪৮ সালের কথা এখন স্মৃতিতে ভাসছে। বেশিরভাগ খেলার সাথি ছিল ছেলেবন্ধু। পেয়ারা পাড়ার জন্য সবাই আমাকে গাছে উঠিয়ে দিল। গাছের মালিক এলে বন্ধুরা দৌড়ে পালিয়ে যায়। পরে পাশের বাড়ির মালিক আমার হাত ধরে মায়ের কাছে নিয়ে গেলেন। ওই দিন মা আমাকে হাতপাখা দিয়ে মেরেছিলেন। বাবার কাছে মা নালিশ দিলেন। কিন্তু তিনি আমাকে বকা দেননি। পরদিন এক ঝুড়ি পেয়ারা বাজার থেকে আমাকে এনে দেন বাবা। আমি তো মহাখুশি। বাবা বললেন, কত খাবে খাও। মানুষের বাড়ি গিয়ে পেয়ারা চুরি করবে না কখনও। এটি মধুর স্মৃতি ছিল। এ ঘটনা যখনই মনে পড়ে, তখন মনে হয়, স্নেহভরে ভালোবেসে এখন তো শাসন করার কেউ নেই। তারা আমার সাফল্য দেখে যেতে পারেননি। বাবা-মা বেঁচে থাকলে আমার সাফল্যে খুবই খুশি হতেন।
লেখক: অভিনেত্রী