খোকন কুমার রায়:
অবাক কাণ্ড তাই না? সব কিছু থমকে গেছে, থেমে গেছে নাগরিক জীবনের সকল ব্যস্ততা। জেগে উঠছে প্রকৃতি, ভারসাম্য আসছে প্রাকৃতিক পরিবেশে। আমার চার বছরের মেয়ে হঠাৎ বলে উঠলো, জানো বাবা, কক্সবাজারের সাগরে না ডলফিন এসেছে, অবাক কাণ্ড! এগুলো নিশ্চই ইন্দোনেশিয়ার বালি হতে এসেছে।
আমি অবাক হলাম। প্রসঙ্গত, গত জানুয়ারি মাসে আমরা বালি হতে ঘুরে এসেছি। সেখানকার সাগরে সে ডলফিন দেখেছে। কক্সবাজারে ডলফিন আসার খবরটি সে কারো কাছ থেকে শুনেছে। তাকে আমি কক্সবাজারেও সাগর দেখাতে নিয়ে গিয়েছি কিন্তু সেখানে তো ডলফিন দেখেনি। তাই তার মনে হয়েছে এগুলো বালি হতে এসেছে। আমি বললাম, আমাদের সাগরেও ডলফিন আছে। উত্তরে সে বললো, তাহলে আগে দেখিনি কেন? আমি তার এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলাম না। কারণ আমরাই প্রকৃতিকে ধ্বংস করেছি, আমরাই প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মের ছন্দোপতন ঘটিয়েছি আমাদের স্বার্থে।
মাত্র কয়েকদিনের অবরুদ্ধ অবস্থায় প্রকৃতি তার নিজস্ব ছন্দে ফিরতে শুরু করেছে। মানুষের ভয়ে পালিয়ে থাকা প্রাণীগুলোর দেখা মিলছে আর মানুষগুলো এক অদৃশ্য প্রাণীর ভয়ে লুকিয়ে পড়েছে। এই হলো প্রকৃতির খেলা। নিশ্চই প্রকৃতি অদৃশ্য ঘাতক ভাইরাসটিকে বাহবা দিচ্ছে। এ যেন প্রকৃতিরই প্রতিশোধ।
আমরা নিজেদের স্বার্থে অত্যন্ত ঘৃণ্যভাবে নদ-নদী-খাল হত্যা করেছি। কলকারখানা ও মনুষ্য সৃষ্ট দূষণে ধ্বংস করেছি নদ-নদীর প্রাণ- পানি, জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীগুলোকে। অত্যন্ত জঘণ্যভাবে কেটেছি পাহাড়, উজার করেছি বন-জঙ্গল। ধ্বংস করেছি পাহাড় ও বন-জঙ্গলের জীববৈচিত্র্য। ক্রমাগত দূষণে অসহনীয় হয়ে পড়েছে বাতাস। ক্রমাগত শব্দ দূষণে অস্থির হয়ে পড়েছি আমরা। অবিরত খাদ্য দূষণে হারিয়েছি পুষ্টি, গিলেছি বিষ। সর্বোপরি সামগ্রিকভাবে একটি দূষিত পরিবেশের দূষিত বাসিন্দা আমরা। টাকা-পয়সা, ধন-দৌলত এ সমস্ত জাগতিক ভোগের বস্তু কোনোভাবেই এসব দূষণ থেকে আমাদের মুক্ত করতে পারবে না। বর্তমান অবস্থায় এ অভিজ্ঞতাই বিশ্ববাসীর হচ্ছে।
তাহলে আমরা কেন নিজেদেরকে ধ্বংসের খেলায় মেতেছিলাম এতোদিন? এক অদৃশ্য ভাইরাসের কাছে গোটা মানব জাতি অসহায়। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করেও কি মুক্তি মিলছে? কী হচ্ছে প্রকৃতিকে ধ্বংস করে উপার্জিত টাকা-পয়সা ধন-দৌলত দিয়ে? প্রকৃতির ওপর নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ বোধ হয় প্রকৃতিও ক্ষমা করেনি। তাই চরম শিক্ষা দিচ্ছে গোটা মানব সম্প্রদায়কে।
অবাক হয়েছি শুনে যে, গত কিছু দিনের অবরুদ্ধ অবস্থায় প্রকৃতি আবার নিজ রূপে ফিরে যাচ্ছে। ঝলমলে আকাশ, বিশুদ্ধ বায়ু, জলের, স্থলের প্রাণীসমূহের নির্বিঘ্নে চলাফেরা। আরো কতো পরিবর্তন! পরিবর্তিত পৃথিবী ও জাতি দেখার অপেক্ষায় আছি যেখানে পরিচ্ছন্ন প্রকৃতি ও মানুষ দেখতে পাবো।
নিশ্চই একদিন মানব জাতি করোনা ভাইরাস মুক্ত হবে এবং মানুষও দূষণমুক্ত পরিবেশে তার স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ফিরে পাবে। একদিন এই করোনা ঝড় থেমে যাবে এবং পৃথিবী আবার মানব চাঞ্চল্যে ভরে উঠবে। আতঙ্কিত নই, আশাবাদী।
লেখক: সম্পাদক ও প্রকাশক, ধূমকেতু.কম।