তাপস দাস :
বর্তমান বিশ্বরাজনীতিতে এখন সবথেকে চর্চিত সংবাদ হল আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের বিষয়টি। আফগানিস্তানে শান্তি স্থাপনের উদ্দেশ্যে কাতারের রাজধানী দোহাতে যে চুক্তি (দোহা চুক্তি) হয়েছিল সেই চুক্তি অনুযায়ী চলতি বছর সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে মার্কিন সেনা আফগানিস্তান থেকে চলে যাবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর তালিবান আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করবে। স্বাভাবিকইভাবে প্রশ্ন ওঠে যদি তালিবান আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে তাহলে বিশ্বরাজনীতি তথা দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষমতার রাজনীতিতে কী ধরনের সামাজিক এবং রাজনৈতিক পরিবর্তন আসতে পারে?
একথা অস্বীকার করার জায়গা নেই, রাজনীতিতে আফগানিস্তান যেহেতু সার্কের একটি সদস্য রাষ্ট্র, সুতরাং দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষমতার রাজনীতির সমীকরণে একটি পরিবর্তন যে ঘটবে সেটা বলাই যেতে পারে। সার্কে ব্যাকফুটে যাওয়া পাকিস্তান নতুনভাবে তার ধর্মীয় রাজনীতিকে ব্যবহার করবে সেটাই স্বাভাবিক।
তবে এই লেখার উদ্দেশ্য তালিবান-পরবর্তী সার্কের রাজনীতির সমীকরণ বোঝা নয়, আমি এই লেখার মধ্যে বোঝার চেষ্টা করবো আফগানিস্তানে যদি তালিবান ক্ষমতায় আসে তাহলে বাংলাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কোনো পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা আছে কিনা। বিষয় শুনে মনে হতে পারে আফগানিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনীতির সম্পর্ক কোথায়?
স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে যে ইসলামীকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল তার ফলস্বরূপ ২০০১ সালে বাংলাদেশে চরম দক্ষিণপন্থী ইসলামিস্ট সরকার ক্ষমতায় আসে এবং তখন থেকে বাংলাদেশের একাংশের মুখের স্লোগান হয়ে উঠেছিল ‘বাংলা হবে আফগান, আমরা হবো তালিবান’; শুধু সেই সময় নয়, বর্তমান সরকারের আমলে একাধিক ওয়াজ মাহফিলে শোনা যায় একই স্লোগান, সর্বোপরি সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী-বিরোধী যে মিছিল ইসলামিস্টরা বের করেছিল, সেই মিছিলে একই স্লোগান ধ্বনিত হতে শোনা যায়।
আসলে স্বাধীনতার পরবর্তী বাংলাদেশে যে ইসলামীকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল তার দুটি দিক ছিল। একটি অভ্যন্তরীণ এবং অন্যটি বৈদেশিক। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর পর সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে জেনারেল জিয়া যে পরিবর্তনগুলি এনেছিলেন তাতে বাংলাদেশের সঙ্গে বিশ্বের অন্যান্য ইসলামিক রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে সখ্যতা গড়ে ওঠে এবং বৈদেশিক অর্থানুকূল্যে গড়ে ওঠে শত শত মাদ্রাসা। আর এই ভাবেই আফগানিস্তানের লড়াই হয়ে ওঠে বাংলাদেশের ইসলামিস্ট লড়াই।
আশির দশক থেকে বাংলাদেশকে ‘আফগানিস্তান’ বানানোর স্বপ্নের জাল বোনা শুরু হয়। আশির দশকে আফগানিস্তানে সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধে যোগ দিতে বাংলাদেশ থেকে গিয়েছিলেন বেশ কিছু তরুণ-যুবা, যাদের একটি বড় অংশ উগ্রপন্থি ধারার কওমি মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক। ১৯৮৯ সালে হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশ (হুজি-বি) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যশোরের মনিরামপুরের মাওলানা আবদুর রহমান ফারুকী। কিন্তু ওই বছরই আফগানিস্তানের খোস্তে মাইন অপসারণের সময় মাওলানা ফারুকী নিহত হন। পাকিস্তানি জঙ্গি সংগঠনের শাখা হিসেবে ১৯৯২ সালে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা পায় হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী (হুজি)। তালেবান নেতা ওসামা বিন লাদেন এদেশে হুজি প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেছিলেন। সেই হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী (হুজি) কার্যত ১৯৯২ সালের ৩০ এপ্রিল ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। তাছাড়া ১৯৯৯ সালে গ্রেফতারকৃত পাকিস্তানি ও দক্ষিণ আফ্রিকার নাগরিক দুজনের জবানবন্দি থেকে জানা যায়, বিন লাদেন বাংলাদেশ থেকে তালেবান রিক্রুট করার জন্য দুকোটি টাকা দিয়েছেন যা তারা ৪২১টি মাদ্রসায় দিয়েছেন তালেবান রিক্রুট করার জন্য। ১৯৯২ সালে আফগান ফেরত মুজাহিদরা গড়ে হরকাতুল জিহাদ। তাদের লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশকে আফগানিস্তান বানানো। হরকাতুল জিহাদই সবচেয়ে বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতা চালিয়েছে। সংগঠনটি প্রথম নাশকতামূলক বোমা হামলা করে যশোরে উদীচীর অনুষ্ঠানে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ১৯৯৯ সালের ৬ মার্চ ওই হামলায় ১০ জন নিহত ও শতাধিক ব্যক্তি আহত হন। এর আগে হরকাতুল জিহাদের সদস্যরা ১৯৯৯ সালের ১৮ জানুয়ারি ঢাকায় কবি শামসুর রাহমানের বাড়িতে তার উপর হামলা, ২০০৩ সালের ২৩ জুলাই গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় শেখ হাসিনার সভাস্থলে বোমা স্থাপন করে, ২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল রমনার বটমূলে বোমা হামলা, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট পল্টনে গ্রেনেড হামলা, ২০০৪ সালে সিলেটে হযরত শাহজালাল (রঃ) এর মাজার শরীফ জিয়ারতকালে সাবেক ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর উপর বোমা হামলা, ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি হবিগঞ্জের বৈদ্যেরবাজারে সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়ার জনসভায় গ্রেনেড হামলা চালিয়ে হত্যা, ২০০১ সালে আরেক লেখক হুমায়ুন আজাদকে ছুরিকাহত করা ছাড়াও ৯০-র দশকের প্রথম দিকে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের উপর সশস্ত্র আক্রমণ, যশোরে উদীচীর সম্মেলনে হামলা, গোপালগঞ্জের বানিয়ারচর জলিরপাড়ে, পুরানা পল্টনে সিপিবি’র সমাবেশে হামলা, নারায়ণগঞ্জের চাষাড়ায় আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে হামলা, সিলেটে হযরত শাহজালাল (রঃ) এর মাজার শরীফে বার্ষিক ওরশ চলাকালে হামলা, বাগেরহাটে শেখ হেলালের জনসভায় মুফতি হান্নানের পরিকল্পনা ও নির্দেশে জঙ্গিরা বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল বলে গোয়েন্দারা তথ্য পান। এসবই হচ্ছে জেএমবি ও হরকাতুল জিহাদের নেতৃত্বে বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতার উল্লেখযোগ্য ঘটনা। নরেন্দ্র মোদিকে ঠেকাতে প্রয়োজন হলে ‘বাংলা হবে আফগান, আমরা হবো তালেবান’। এসময় যে কোনো মূল্যে তার আগমন প্রতিহত করার ঘোষণাও দেন তারা।
আলোচনার নিরিখে একথা বলার কোনো অবকাশ থাকে না যে বাংলাদেশের সঙ্গে আফগানিস্তানের জঙ্গিগোষ্ঠীর সম্পর্ক ঐতিহাসিক এবং গভীর। সম্প্ৰতি গণমাধ্যমে দেখা গেছে একটি ওয়াজ মাহফিলে একজন হুজুর তালিবানের সঙ্গে মার্কিনিদের চুক্তিকে তালেবানের জয় হিসেবে দেখে খুব উৎফুল্ল হয়ে পড়েছিলেন। আমি এই ধারণা থেকেই মনে করি আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারকে বাংলাদেশের তালিবানি জঙ্গি সংগঠনসহ অনান্য সংগঠন তালিবানের জয় হিসেবে মেনে নিয়ে বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতা বাড়াতে পারে।
একথা ঠিক, বর্তমান সরকার জঙ্গি কার্যক্রমের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করেছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও গত এক দশকে জঙ্গি তৎপরতা একেবারে কমানো যায়নি, যার বড় উদাহরণ হিসেবে হোলি আর্টিসান ঘটনা অন্যতম। তাই আমি মনে করি তালেবান ক্ষমতায় আসলে বাংলাদেশের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সরকারের বাড়তি তৎপরতার প্রয়োজন আছে এবং এই ঘটনা বাংলাদেশের ইসলামিস্টদের উজ্জীবিত করবে।
তাপস দাস, গবেষক, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, কলকাতা।
তথ্যসূত্র :
আলী রিয়াজ (২০০৮), ইসলামিস্ট মিলিটেন্সি ইন বাংলাদেশ : এ কমপ্লেক্স ওয়েব, রুটলেজ, লন্ডন ও নিউইয়র্ক, পৃষ্ঠা : ১১৬
শাহরিয়ার কবির (২০১৯), সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদ মুক্ত বাংলাদেশ, অনন্যা, ঢাকা, পৃষ্ঠা : ৫৩
শাহরিয়ার কবির (২০০৬), বাংলাদেশে জঙ্গী মৌলবাদ, অনন্যা, ঢাকা, পৃষ্ঠা : ১৩-৩১
শাহরিয়ার কবির (২০১৫), সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, চারুলিপি, ঢাকা, পৃষ্ঠা : ৭৭