অভিমত

আফগানিস্তানে তালেবান, বাংলা কখনো হবে না আফগান

তাপস হালদার :

গত ১৫ আগস্ট কাবুল দখলের মধ্য দিয়ে আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নেয় তালেবান। দীর্ঘ ২০ বছর পর আবার তারা ক্ষমতার মসনদে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে। আফগানিস্তানে কে ক্ষমতায় যাবে, আর কে ক্ষমতায় থাকবে সেটি নিয়ে সিন্ধান্ত নিবে সে দেশের জনগণ। তাহলে আফগানিস্তানের ক্ষমতার পালাবদলের সাথে বিশ্বসম্প্রদায় এত চিন্তিত কেন? সেটির মূল কারণ, যে তালেবান ক্ষমতা দখল করেছে তাদের অতীত কার্যক্রম।

বাংলাদেশে আফগান জিহাদ ফেরত যোদ্ধাদের মাধ্যমে জঙ্গিবাদের জন্ম হয়। বিভিন্ন সময় বাংলাদেশ থেকে এক শ্রেণীর কিছু সংখ্যক লোকজন তালেবানের হয়ে আফগানিস্তানে যুদ্ধ করতে গেছে; তারা  দেশে ফিরে বাংলাদেশে তালেবান শাসন কায়েমের লক্ষ্যে জঙ্গি কার্যক্রম শুরু করেছিল। নব্বইয়ের দশকে বিএনপির শরিক দলগুলো ঢাকার রাজপথেই স্লোগান দিত ‘আমরা সবাই তালেবান, বাংলা হবে আফগান।’আফগানিস্তানে তালেবানের ক্ষমতা দখল এই গোষ্ঠীকে আবার নতুন করে কিছুটা উজ্জীবিত করেছে। যার বহিঃপ্রকাশ দেখা গেছে গত ১৭ আগস্ট জিয়ার মাজারে পুলিশের সাথে দলের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ চলাকালে। ঘুমন্ত বিএনপি হঠাৎ করে লাঠিসোঁটা নিয়ে মাজারে উপস্থিত। এই উগ্রপন্থি গ্রুপটি সবসময়ই বিএনপির উপর ভর করেই তাদের কার্যক্রম চালাতে চেষ্টা করে। অস্বীকার করার তো উপায় নেই বাংলাদেশের জঙ্গিবাদের সাথে যারা জড়িত তাদের অনেকের সাথেই তালেবানের সম্পর্ক ছিল।

আফগানিস্তানে তালেবানের উত্থান সম্পর্কে একটু জানা দরকার। আফগানিস্তানে ৩৪টি প্রদেশ ও ৪২১টি জেলা রয়েছে। ১৯১৯ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে আফগানিস্তান মুক্তিলাভ করে। ১৯৬০ সালের দিকে রাজা জহির শাহের সময়ে আফগানিস্তান অর্থনৈতিক দিক দিয়ে অনেক ভালো অবস্থানে ছিল। সত্তরের দশক থেকেই আফগানিস্তানে একটি অস্থির  পরিবেশ  শুরু হয়। ১৯৭১ সালে দাউদ খান বিদ্রোহ করে আফগানিস্তানের রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। ১৯৭৮ সালে রাশিয়া সমর্থক কমিউনিস্ট পার্টির আরেকটি গ্রুপ পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটায়। ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত রাশিয়া কমিউনিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য আফগানিস্তানে সেনাবাহিনী প্রেরণ করে যা ১৯৮৯ সালে  প্রত্যাহার করে নেয়ার  পরে দেশটিতে  গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের আধিপত্য রুখতে যুক্তরাষ্ট্র তালেবানকে সামনে নিয়ে আসে। ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসনের পর তাদের বিরুদ্ধে স্থানীয় প্রতিরোধ শুরু হয়। জন্ম হয় তালেবানের। যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে আফগান মুজাহিদিনদের নিয়ে গঠিত সংগঠনটি সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে জনগণের বৃহৎ একটি অংশকে আকৃষ্ট করেছিল।

সোভিয়েত ইউনিয়নের সেনারা সরে যাওয়ার পর ও তাদের সমর্থিত সরকারের পতন হওয়ায় আফগানিস্তানের কয়েকটি গোষ্ঠীর মধ্যে যুদ্ধ হয়, তার মধ্যে তালেবান ছিল সর্ববৃহৎ গোষ্ঠী।

তালেবান সংগঠনের সবাই পশতু সম্প্রদায়ের লোক। ১৯৯৪ সালে তালেবানের সশস্ত্র আবির্ভাব ঘটে আফগানিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর কান্দাহারে। সংগঠন তৈরির দুই বছরের মধ্যেই তালেবান রাজধানী কাবুলসহ আফগানিস্তানের বেশিরভাগ অংশের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতা দখল করে  কঠোর শরিয়া আইন চালু করে। ক্ষমতায় থাকাকালে পাঁচ বছরে আফগানিস্তানে তাদের কঠোর শরিয়া আইন চাপিয়ে দিয়েছিল তালেবান।

১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকে তালেবান। ২০০১ সালে আমেরিকার টুইন টাওয়ারে হামলার পর আল কায়দা নেতা লাদেনের খোঁজে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো দেশগুলো কর্তৃক পরিচালিত যৌথ অভিযানে তালেবান শাসনের অবসান ঘটে। তালেবান নেতারা অনেকেই বন্দী হন, বাকিরা পালিয়ে যান। ক্ষমতায় থাকার সময় তালেবান শরিয়াহ্‌ভিত্তিক ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিল। ১৯৯৬ সালে তারা ক্ষমতায় আসার পর আফগানিস্তানে ইসলামি আমিরাত প্রতিষ্ঠা করে।

জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, আফগানিস্তানে ১৯৯৬ এবং ২০০১ এর মধ্যে “১৫টি গণহত্যা” হয়েছিল। নারীদের ওপর  তালেবানদের নিষ্ঠুর সংহিসতা পৃথিবীব্যাপী ঘৃণিত। জাতিগত সংখ্যালঘু বিশেষ করে তাজিক, উজবেক, হাজারা এবং আফগানিস্তানের অন্যান্য অ-পশতুন জাতিগোষ্ঠীর নারীদের অপহরণ করে পাকিস্তান ও আরব দেশসমূহে  যৌনদাসী হিসেবে বিক্রি করে। অনেক নারী দাসত্বের চেয়ে আত্মহত্যাকে বেছে নিয়েছে। নারী শিক্ষায় ফতোয়া দেয়ার ফলে মেয়েরা স্কুল কলেজ ছাড়তে বাধ্য হয়। মহিলাদের বোরকা পরা ও ঘর থেকে বের হলে সাথে একজন পুরুষ আত্মীয় থাকা বাধ্যতামূলক করা হয়। নিয়ম অমান্য করলে প্রকাশ্যে নিষ্ঠুর শাস্তি ভোগ করতে হতো।

তালেবানরা অমুসলিমদের বিরুদ্ধে আদেশ জারি করেছিল তারা উপাসনালয় নির্মাণ করতে পারবে না। যারা  অমুসলিম তাদের বাড়ির ছাদে হলুদ কাপড় লাগিয়ে তাদের বাড়ি চিহ্নিত করার নির্দেশ দেয়া হয়। অমুসলিমদের সাথে মুসলমানদের বসবাসে দেয়া হয়েছিল নিষেধজ্ঞা, অমুসলিম মহিলাদের একটি বিশেষ চিহ্ন দিয়ে হলুদ পোশাক পরতে বলা হয় যাতে মুসলমানরা তাদের দূরত্ব বজায় রাখতে পারে। যার কারণে হিন্দু এবং শিখদের জনসংখ্যা খুব দ্রুত হারে হ্রাস পেতে থাকে।

আফগানিস্তানের প্রায় অর্ধেক স্কুল ধ্বংস করে তালেবানরা। নৃশংস হামলা চালিয়ে শতশত শিক্ষক ও শিক্ষার্থীকে হত্যা করা হয়। ১৯৯৮ সালে  পুলি খুমরি পাবলিক লাইব্রেরি ধ্বংস করা হয়। এটি আফগানদের জাতি ও সংস্কৃতির সবচেয়ে মূল্যবান সংগ্রহশালা ছিল।

২০০১ সালের অক্টোবরে জাতীয় জাদুঘরের অন্তত ২,৭৫০টি শিল্পকর্ম ধ্বংস করে। লোকসংগীতসহ সমস্ত সঙ্গীত নিষিদ্ধ করা সহ বেশ কয়েকজন সংগীতশিল্পীকে হত্যাও করা হয়। টেলিভিশন, চলচ্চিত্র, গান এবং স্যাটেলাইট ডিশের মতো সাধারণ বিনোদনও নিষিদ্ধ করা হয়। ফুটবল, ঘুড়ি ওড়ানো এবং দাবাসহ অনেক বিনোদনমূলক খেলাও নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। তাদের পাঁচ বছর একটি বর্বরতার শাসন ছিল আফগানিস্তানে। এখানেই বিশ্ব সম্প্রদায়ের উদ্বেগের কারণ।

আফগানিস্তান ফেরত বাংলাদেশিরাই দেশে ফিরে হরকাতুল জিহাদ (হুজি) ও জেএমবিসহ একাধিক জঙ্গিগোষ্ঠী তৈরি করে। এসব জঙ্গিগোষ্ঠী তৈরির প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল তারা কাশ্মিরে গিয়ে যুদ্ধ করবে। তারা আফগানিস্তানে যুদ্ধ করে জয় লাভ করেছে, তারা কাশ্মিরে গিয়ে যুদ্ধ করেও জয়লাভ করবে- এমন ধারণা ছিল। এরপর নানাবিধ কারণে তারা কাশ্মির মিশন সফল করতে পারেনি। তারপর বাংলাদেশেই তারা খিলাফত কায়েমের জন্য আন্দোলন শুরু করে। দেশের বিভিন্ন স্থানে বোমা হামলা করে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করে। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে জেএমবি তো পুরো উত্তারাঞ্চলে আলাদা শাসন চালু করেছিল। হরকাতুল জিহাদ (হুজি) ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় সরাসরি সম্পৃক্ত ছিল।

বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর জঙ্গিবাদকে কঠোর হস্তে দমন করেছে। জঙ্গিবাদ সম্পূর্ণ রূপে নির্মূল হয়ে গেছে এটি বলা যাবে না, তবে তারা যে সক্ষমতা হারিয়ে নিয়ন্ত্রণে রয়েছে সেটি নিঃসন্দেহে বলা যায়।

কোনো দেশে জঙ্গিবাদ বিস্তারের ক্ষেত্রে অবশ্যই রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা থাকতে হয়। যেটি বাংলাদেশে চারদলীয় জোট সরকারের সময় ছিল। তখন জঙ্গিরা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় রাম-রাজত্ব কায়েম করেছিল। কিন্তু বর্তমান দেশরত্ন শেখ হাসিনার সরকার জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে। এখন এদেশে জঙ্গিদের আস্ফালনের কোনো সুযোগ নেই। তাই তালেবানেরা আফগানিস্তানে ক্ষমতায় আসলেও বাংলাদেশের উগ্রপন্থীদের দিবাস্বপ্ন দেখে কোনো লাভ হবে না। বাংলাদেশ কখনো আফগান হবে না।

লেখক: সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ ও সাবেক ছাত্রনেতা।

ইমেইল: haldertapas80@gmail.com

(ধূমকেতু ডটকম-এর অভিমত/মতামত বিভাগে প্রকাশিত লেখার আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, ধূমকেতু ডটকম কর্তৃপক্ষের নয়)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *