ডেস্ক প্রতিবেদন, ধূমকেতু বাংলা: গাছের জীবন্ত শেকড়ের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে শত শত বছর ধরে টেকসই সেতু বানিয়ে আসছেন উত্তরপূর্ব ভারতের আদিবাসী জনগোষ্ঠী।

মেঘালয়ের দ্বিতল এই শেকড় সেতু এখন বিখ্যাত। পুরো পৃথিবী থেকেই পর্যটকরা এটি দেখতে আসেন।

বর্ষাঘন পাহাড়ের কোলে ছোট্ট গ্রাম- তিরনা। কোলঘেঁষে পাহাড়ি ঝর্ণা থেকে বয়ে চলা ঝিরির খাদ। খাদটি পার হতে নিজেরাই সেতু বানিয়েছেন গ্রামবাসী। তবে ইস্পাত, কাঠ বা কংক্রিটের নিষ্প্রাণ উপকরণে নয়। এ সেতু জীবন্ত প্রকৃতিরই অংশ।

তিরনা গ্রামের মেয়ে শৈলিন্দা শিমলিয়েহ। প্রতিদিন এ সেতুপথেই তার আসা-যাওয়া।

যার পাটাতন তীরের একটি ডুমুর গাছের বর্ধিত অংশ। দুই পাশের হাতলও রাবার গাছের ঝুলন্ত শেকড় পাকিয়ে বানানো।

ফলে চারপাশের সবুজ অরণ্য-পাহাড়ের সাথে মিশে যায় এ সেতু। মানুষের কাঠামো বলে তাকে আলাদা করার উপায় নেই। একইসঙ্গে, সাহায্য করছে বাস্তুসংস্থানকে ।

বাংলাদেশের সমভূমি ছাড়িয়ে উত্তরপূর্বে সিলেটের পাহাড়শ্রেণি। আরো উপরে মেঘছোয়া পাহাড়ের রাজ্য মেঘালয়। সেখানে এমন শত শত সেতু রয়েছে।

শত শত বছর ধরে এসব সেতুই বর্ষায় ফুলেফেঁপে ওঠা নদী ও ঝিরি পাড়ি দিতে সাহায্য করছে স্থানীয় খাসিয়া ও জৈন্তা সম্প্রদায়কে।

শৈলিন্দা বলেন, ‘আমাদের পূর্বজরা ছিলেন বুদ্ধিমান। যখন তারা নদী পার হতে পারতেন না, তখন তারা জিংকিয়েং জ্রি বানাতেন।’

জীবন্ত শেকড়ে বানানো সেতুরই স্থানীয় নাম- ‘জিংকিয়েং জ্রি’। স্থানীয় জলবায়ুর সাথে তাল মিলিয়েই যার সৃষ্টি।

মেঘালয়েই আছে পৃথিবীর আদ্রতম কিছু অঞ্চল। যেমন সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাতের গ্রাম মস্যন্রাম। গ্রামটিতে বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১১ হাজার ৮৭১ মিলিমিটার বা ৩৯ ফুট। একসাথে এ পরিমাণ বৃষ্টি হলে ডুবে যাবে তিনতলা উঁচু বাড়ি।

নিকটবর্তী সোহরা দ্বিতীয় শীর্ষ বৃষ্টিভেজা গ্রাম। এখানে বৃষ্টিপাত হয় ১১ হাজার ৪৩০ মিলিমিটার বা ৩৭ দশমিক ৫ ফুট।

প্রতিবছরের জুন থেকে সেপ্টেম্বর সময়ে বঙ্গোপসাগর থেকে মৌসুমি মেঘবাহী বাতাস বাংলাদেশের আদ্র সমভূমি পেড়িয়ে আছড়ে পড়ে মেঘালয়ের পাহাড়গুলোয়। জন্ম দেয় অঝোর বৃষ্টির।

প্রাচীনকালে এই বৃষ্টিময় আবহাওয়ায় দূরের নগর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তো দুর্গম পাহাড়ি গ্রামগুলো। আদিকালের বাসিন্দারা তাই ডুমুর ও রাবার গাছের ঝুলন্ত শেকড়কে ইচ্ছেমতো রূপ দিয়ে সেতু তৈরি শুরু করেন।

গবেষকদের মতে, জ্যান্ত শেকড়ের সেতু তৈরির কৌশল স্থানীয়দের জলবায়ু সহনশীল জ্ঞানের উদাহরণ। অনন্য এ সেতু শুধু প্রত্যন্ত এলাকায় যোগাযোগের সুবিধাই দেয় না, পর্যটকরাও ছুটে আসেন এর আকর্ষণে। স্থানীয়রা পান বাড়তি আয়ের সুযোগ।

তারা আরও বলছেন, চারপাশের প্রকৃতিতে নবজন্ম সৃষ্টি করে এসব সেতু।

জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে বিশ্বের অনেক শহরাঞ্চল প্লাবিত হওয়ার ঝুঁকিতে। সেখানে আদিবাসীদের এ প্রকৌশল জ্ঞান কাজে লাগানোর ব্যাপারে ভাবছেন বিজ্ঞানীরা।

ইউরোপের আবাসিক প্রকৌশলে উত্তরপূর্ব ভারতের শেকড় সেতুর বিজ্ঞান কাজে লাগানোর আগ্রহ বাড়ছে।

নির্মাণ কৌশল:

এ সেতু তৈরিতে কয়েক দশক লেগে যায়। প্রথমেই সেতুর জায়গা নির্বাচন করে সেখানে লাগানো হয় রাবার গাছের চারা। মেঘালয়ের আধা-ক্রান্তীয় ভূমিতে সহজেই জন্মায় এ গাছ। গাছের শেকড় মাটিতে দৃঢ়ভাবে বসে যেতে লাগে কমপক্ষে ১০ বছর। গাছ প্রাপ্তবয়স্ক হলেই ডাল থেকে গজাতে থাকে ঝুলন্ত শিকড়। এ গাছের শেকড়ের আছে বাঁকিয়ে আকার দেওয়ার মতো নমনীয়তার গুণ। গজায়ও তুলনামূলক মজবুত ডাল থেকে।

খাসিয়া সেতু তৈরিকারীরা এসব শেকড় বুনে বাঁশ বা কাঠের কাঠামোয় গুঁজে দেন। এরপর কাঠামোগুলো পোঁতা হয় নদীজুড়ে। অপরতীরে মাটিতে পোঁতা হয় শেকড়ের পাকানো গোঁড়াগুলি। কালক্রমে এসব শেকড় আরও পুরুষ্ট হয় । সেখান থেকে জন্ম নেয় আরও শেকড়ের প্রশাখা। এই শেকড়ও নদীর ওপর দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।

এরপর সেগুলো অন্য কোনো রাবার গাছ অথবা শেকড়ের মূল জন্মদাতা গাছের শেকড় ও ডালের সাথেই বেঁধে ফেলা হয়। এভাবে শেকড় বা কাণ্ডের সাথে একাকার হয়ে দৃঢ় রূপ নেয়। বৈজ্ঞানিকভাবে এ প্রক্রিয়ার নাম অ্যানাসটোমোসিস।

শেকড় কাঠামোর শূন্যস্থান পূরণে খাসিয়া প্রকৌশলীরা পাথরখণ্ডও ব্যবহার করেন। সময়ের সাথে সাথে শেকড় যত পূর্ণতা পায়, ততই শক্তিশালী হয় সেতু। মজবুত কোনো কোনো সেতুতে একসাথে ৫০ জনের বেশি মানুষ পার হতে পারে।

সেতুর রক্ষণাবেক্ষণও হয় কয়েক প্রজন্ম ধরে। হয়তো এক প্রজন্ম করেছে মূল কাঠামোর কাজ। আরেক প্রজন্ম করছে সংস্কারের কাজ। আকারভেদে একটি পরিবার বা পুরো গ্রামের সকলে এই প্রক্রিয়ায় জড়িত থাকেন।

অনেক সেতুর ক্ষেত্রে শত শত বছর ধরে চলে আসছে রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়নের কাজ। কয়েকটি সেতু ৬০০ বছরেরও প্রাচীন।

শৈলিন্দা বলেন, এই কাঠামো পুনঃসৃষ্টির। জ্যান্ত শেকড় সময়ের সাথে সাথে আরও শক্তিশালী হয়। কাঠামোর কোনো ত্রুটি প্রকৃতিই মেরামত করে।

‘ভারি বৃষ্টির সময়ে সিমেন্টের তৈরি সেতু সহজেই ভেঙ্গে যায়। আর মরিচা পড়ে লোহার সেতুতে। কিন্তু জীবন্ত শেকড়ের সেতু শুধু বৃষ্টির স্রোত সহ্যই করে না, পানির পুষ্টিতে প্রাণবন্ত ও মজবুত হয়ে ওঠে।’

‘আধুনিক বিকল্পের চেয়েও শেকড়ের সেতু অনেক দীর্ঘস্থায়ী। খরচও একেবারেই নেই। তাই জঙ্গলে উপত্যকার অনেক পরিত্যাক্ত শেকড়ের সেতুকে আবারো সংস্কার করছেন গ্রামবাসী’- বলছিলেন তিনি।

আরো পড়ুন:

লাহোরে ট্রেন থামিয়ে দই কিনায় সাসপেন্ড হলেন চালক!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *