ক্যারিয়ার ও চাকরি

আউটসোর্সিং দিনাজপুরে বসে করছেন ইউরোপের কাজ কর্মসংস্থান আরো ৫০ জনের

নিজস্ব প্রতিবেদক, ধূমকেতু ডটকম: দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলা শহরের শেষ মাথায় শিমুলতলী রেলগেট। সেখান থেকে ১০০ কদম গেলে মাঝাপাড়া গ্রামে বেলাল সরকারের পাঁচতলা বাড়িটি চোখে পড়বে যিনি ‘ইন্টারনেট বেলাল’নামে পরিচিত।

বাংলাদেশের যে তরুণেরা দেশে বসেই আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করেন, বেলাল তাদের একজন। অন্যদের সঙ্গে তার পার্থক্য হলো রাজধানী কিংবা জেলা শহরে নয়, তিনি গ্রামে থেকে কাজ করেন। আরেকটি পার্থক্য হলো, শুধু একা স্বাবলম্বী হননি, কাজের ব্যবস্থা করেছেন নিজের এলাকার ৫০ জন তরুণ-তরুণীর।

চিরিরবন্দর দিনাজপুর শহর থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে। সেখানে পৌঁছে গেছে উচ্চগতির ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা। ফলে বেলাল তার আউটসোর্সিং প্রতিষ্ঠানকে উপজেলার শহরতলিতে নিজের বাড়িতে নিতে পেরেছেন। বেলালের প্রতিষ্ঠানের নাম ক্লিপিং বিডি। এতে কাজ করেন ৫০ জন। ইউরোপের দেশ যুক্তরাজ্য, ডেনমার্ক, সুইডেন এবং যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশের ফটোশপ, ই-বুক ডিজাইন, গ্রাফিক ডিজাইন অ্যান্ড মাল্টিমিডিয়া, ভিডিও অ্যানিমেশন, সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন অ্যান্ড ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের মতো কাজ করে বেলালের প্রতিষ্ঠান মাসে ৮ থেকে ১০ লাখ টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা বাংলাদেশে আনে।

তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের হিসাবে, দেশে প্রায় পাঁচ লাখ তরুণ ইন্টারনেট ব্যবহার করে আউটসোর্সিংয়ের কাজ করেন। তারা বছরে ১০ কোটি ডলার আয় করেন, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৮৫০ কোটি টাকা।

যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ইন্টারনেট ইনস্টিটিউটের (ওআইআই) হিসাবে, অনলাইনে কর্মঘণ্টা বিক্রিতে বাংলাদেশ এখন তৃতীয়। এ তালিকায় ভারত ও পাকিস্তান শীর্ষে রয়েছে।

আউটসোর্সিংয়ের কাজ বেলালের জীবন বদলে দিয়েছে। পরিবারের আর্থিক টানাপোড়েনে একসময় তিনি কম্পিউটার বিষয়ে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হয়েও পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি। এখন ৪০ শতক জমির ওপর একাধিক বহুতল ভবন ও মার্কেট গড়ে তুলেছেন।

বেলালের বাবা স্কুল শিক্ষক আবদুস সামাদের চার ছেলে। বেলাল সর্বকনিষ্ঠ। বড় তিন ভাইয়ের পেশা শিক্ষকতা। তবে ছোটবেলা থেকে বেলালের আকর্ষণ ক্রিকেট আর সংগীতে। ১৯৯৯ সালে মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে কম্পিউটার ট্রেড নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। ওই সময়ই বাবা একটি কম্পিউটার কিনে দেন বেলালকে। এরপর থেকেই কম্পিউটার, ইন্টারনেট ঘিরে বেলালের যত আগ্রহ। কিন্তু হতাশ হতে হয় কম্পিউটার ট্রেডে পড়াশোনা শেষ করার পর। কারণ, গ্রামে কাজের সুযোগ নেই। গেলেন ঢাকায়।

২০০৩ সালে ঢাকায় আইআইএসটি নামের প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার বিষয়ে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হন। পড়াশোনার টাকা জোগাতে না পেরে উইন উইন ইনফোসিস নামের একটি সফটওয়্যার কোম্পানিতে খণ্ডকালীন চাকরি নেন। বেতন ছিল ৫ হাজার টাকা।

বেলাল বলেন, ওই কোম্পানিতে চাকরি পাওয়ার সময়ও আউটসোর্সিং বিষয়ে তেমন কিছু জানতেন না। ধীরে ধীরে জানতে পারেন ইন্টারনেটের মাধ্যমে দেশের বাইরের কাজ করে ভালো আয় করা যায়। নিজে কিছু করার ও কাজ শেখার আগ্রহটা তখন থেকেই। গ্রাফিক ডিজাইন, ওয়ার্ড প্রেসসহ বেশ কিছু বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করেন। ফলে মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে বেতন দাঁড়ায় ২৫ হাজার টাকা।

এরই মধ্যে অন্য একটি সুযোগ পান। গিটার বাজানোর আগ্রহ থেকে পরিচয় হয় আলিয়ঁস ফ্রঁসেসের সদস্য মোকতাদির শিখরের সঙ্গে। একদিন গিয়ে দেখেন শিখর কম্পিউটারে ডিজাইনিং নিয়ে ব্যস্ত। তা দেখে বেলাল শিখরকে বলেন, তিনিও ওই কাজ করতে পারেন। করেও দেখান। বেলালের কাজে খুশি হয়ে শিখর তার পেপাল অ্যাকাউন্ট (আউটসোর্সিংয়ের কাজ করে টাকা আনার মাধ্যম) ব্যবহার করতে দেন। এভাবে ফ্রিল্যান্সিং কাজে বেলালের দক্ষতা বাড়তে থাকে।

২০০৬ সালে বিয়ে করে উত্তরায় বাসা ভাড়া নেন বেলাল। অফিসের কাজ শেষে বাসায় ফিরে নিজেই বাড়তি কাজ করতে শুরু করেন। স্ত্রী শামীমা নাসরীনকেও কাজ শিখিয়ে দেন। পাশাপাশি নিজের গ্রাম থেকে পাঁচজন তরুণকে ঢাকায় আনেন কাজ শেখানোর জন্য। একদিন পেয়ে যান ১৪ হাজার ডলারের একটি কাজ। বেলাল বলেন, ‘একসময় বুঝতে পারি, চাকরি আর নিজের কাজ—দুটি একসঙ্গে হবে না। তাই চাকরি ছেড়ে দিয়ে ক্লিপিং বিডি নামে নিজের প্রতিষ্ঠান খুলি।’

ঢাকা থেকে রংপুর

রংপুরে উচ্চগতির ইন্টারনেটের খবর পেয়ে ২০১০ সালে সেখানেই চলে যান বেলাল। একটি ভাড়া বাড়িতে ৪০ জন তরুণকে নিয়ে কাজ শুরু করেন। তবে ইচ্ছা ছিল নিজের গ্রামে ফেরা। অপেক্ষায় ছিলেন সেখানে কবে উচ্চগতির ইন্টারনেট যাবে। তিন বছরের মধ্যে মাঝাপাড়াতে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট গেল। বেলালও গ্রামে ফিরলেন। ৪০টি কম্পিউটার নিয়ে নিজেদের বাড়ির নিচতলা ও দ্বিতীয় তলায় কাজ শুরু করল ক্লিপিং বিডি।

বেলাল বলেন, ‘এলাকার মানুষ প্রথমে আমাকে সহজভাবে নিতে পারেননি। পাঁচতলা বাড়ি বানানো, মার্কেট বানানো, এতগুলো লোক এখানে কী কাজ করে—এসব নিয়ে নানা আলোচনা চলত।’

কিন্তু একসময় কাজের পরিধি বাড়ায় এলাকার ৭৫ জন তরুণ-তরুণীকে কাজ শেখানোর উদ্যোগ নেন বেলাল। পরে তারা বেলালের প্রতিষ্ঠানেই কাজ শুরু করেন। বেলাল বলেন, তার প্রতিষ্ঠানে কাজ করে প্রতি মাসে তরুণেরা ৫ থেকে ৮ হাজার টাকা আয় করতে শুরু করেন। এরপরই এলাকার মানুষের নেতিবাচক চিন্তা দূর হয়।

দক্ষতা আর পরিশ্রমই সব

বেলাল বলেন, দক্ষতা, পরিশ্রম ও ধৈর্য না থাকলে আউটসোর্সিংয়ে ভালো করা কঠিন। অনেক সময় নিজের ভুলগুলো ধরা যায় না। সে জন্য অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা জরুরি। তা ছাড়া কাজের মান খারাপ হলে দেশের ফ্রিল্যান্সারদের প্রতি বিদেশি গ্রাহকদের আস্থা কমে যাবে। আগামী দিনে বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সিং খাতে প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে।

আউটসোর্সিংয়ের কাজে কোনো সময়সীমা নেই। ২৪ ঘণ্টাই কর্মসময়। এর মধ্যেই স্ত্রী ও দুই মেয়ের দেখাশোনা ও সংসারের দেখভাল করতে হয় বেলালকে। অবশ্য ছোটবেলার খেলাধুলা আর সংগীতকে ভুলে যাননি বেলাল। বাড়ির আঙিনার মধ্যে ‘ইনডোর’ কক্ষে খেলাধুলার ব্যবস্থা করেছেন। সেখানে প্রায় সারাক্ষণই বিভিন্ন বয়সীরা মেতে থাকেন ব্যাডমিন্টন খেলায়। গত বছর জেলা পর্যায়ে চ্যাম্পিয়নও হয়েছে বেলালের প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের দল।

অন্যদিকে বাড়ির নিচতলায় অফিসকক্ষের পাশে গড়ে তুলেছেন স্টুডিও। নিজেও যেমন গিটার বাজান, তেমনি যুক্ত হয়েছেন স্থানীয় কয়েকজন শিল্পী। নিজেরা গান লিখেন, সুর করেন। ইউটিউব চ্যানেলে প্রচার করেন নিজেদের কম্পোজ করা গানগুলো।

বেলাল স্থানীয় ও জাতীয়ভাবে প্রশংসিত ও সম্মানিত হয়েছেন। দিনাজপুর জেলা প্রশাসনের ডিজিটাল উদ্ভাবনী মেলা, জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সপ্তাহে উপজেলা পর্যায়ে, জেলা প্রশাসন থেকে সম্মাননা পেয়েছেন। গত বছর ঢাকায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং বা বিপিও সামিটে আমন্ত্রিত বক্তা হিসেবে অংশ নিয়েছেন। ‘চাকরি খুঁজব না চাকরি দেব’ প্ল্যাটফর্ম থেকে পেয়েছেন ‘উদ্যোক্তা সম্মাননা’।

চিরিরবন্দরের বেলাল এখন অনেকের কাছেই উদাহরণ। তিনি বলেন, ‘বেকারত্ব কোনো সমস্যা নয়, কাজের প্রতি অনাগ্রহটাই মূল সমস্যা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *