অভিমত

অসাম্প্রদায়িকতা ও মানবতার মূর্ত প্রতীক কাজী নজরুল

তাপস হালদার

২৫ মে, ১৮৯৯ সাল। পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্ম নেন ‘দুখু মিয়া’। তাঁর পিতা কাজী ফকির আহমেদ মসজিদের ইমাম ও মাজারের খাদেম ছিলেন। সঙ্গত কারণেই তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয় মাদ্রাসায় এবং পিতার মৃত্যুর পর অল্প বয়সেই জীবিকার তাগিদে কাজ নিয়েছিলেন মুয়াজ্জিনের। যার কারণে শৈশবেই রপ্ত হয় ইসলাম ধর্মের মৌলিক আচারগুলো। অথচ তিনিই পরবর্তীতে বাঙালিদের কাছে অসাম্প্রদায়িক চেতনার মূর্ত প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন। কর্মে ও সাহিত্য সাধনায় বারবার তার প্রতিফলন ঘটেছে। নিজেকে সর্বদা রেখেছেন জাতি-ধর্ম-বর্ণ ও সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে। তিনিই সর্বপ্রথম বাংলা সাহিত্যে অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। তিনি কবি, সাহিত্যিক, সংগীতজ্ঞ, সাংবাদিক, রাজনীতিক ও সৈনিক হিসেবে যে ক্ষেত্রেই কাজ করেছেন সেখানেই অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। বিশেষ ধর্ম ও লিঙ্গ বৈষম্যের বিরুদ্ধে আজও আমাদের আলোর পথ দেখায়।

বর্তমান সময়ে বিশ্বের অনেক দেশেই সাম্প্রদায়িক বিভাজন অনেক প্রকট সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশে দেশে চলছে ধর্মীয় বিভাজন ও সাম্প্রদায়িকতার নগ্ন বহিঃপ্রকাশ। নিজের ধর্মকে বড় করে তুলতে অন্য ধর্মের প্রতি ছড়ানো হচ্ছে বিদ্বেষ ও ঘৃনা। এ থেকে উত্তরণের উপায় হচ্ছে অসাম্প্রদায়িক চেতনা। যেটি আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম মনেপ্রাণে ধারণ ও লালন করতেন।

কাজী নজরুল ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে কখনো ছিলেন না, ছিলেন ধর্ম ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে। তাই তো হিন্দু মুসলমান কবিতায় বলেছেন, ‘মোরা এক বৃত্তে দুইটি কুসুম হিন্দু মুসলমান/মুসলমান তার নয়ন-মনি, হিন্দু তাহার প্রাণ।’

নজরুলের সত্তা জুড়ে ছিল অসাম্প্রদায়িক চেতনা, তাঁর সংগ্রাম ছিল সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে। তিনি সকল ধর্মীয় অধিকারে বিশ্বাস করতেন। তিনি ছিলেন ধর্ম-বর্ণ-সাম্প্রদায়িকতার উর্ধ্বে একজন মহামানব। তাঁর নিজের জীবনেও সেটা দেখতে পাই। হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রমিলা দেবীকে তিনি বিয়ে করেছিলেন কিন্তু তাকে ধর্মান্তরিত করেননি। মুসলিম সমাজ থেকে যখন প্রমিলা দেবীকে ধর্মান্তরিত করার জন্য চাপ দেয়া হয়েছিল তখনও তিনি তাদের সে মতকে সমর্থন তো করেননি বরং প্রত্যাখ্যান করেছেন। এমনকি পরবর্তীতে তাঁর সন্তানদের নাম রাখার ক্ষেত্রেও দুই ধর্মের মিলিত ঐতিহ্যকে ধারণ করেছেন। তাঁর প্রথম সন্তানের নাম রেখেছিলেন — কৃষ্ণ মুহাম্মদ। তারপর পর্যায়ক্রমে অরিন্দম খালেদ, কাজী সব্যসাচী, কাজী অনিরুদ্ধ। কবি নজরুল জানতেন এবং বিশ্বাস করতেন শাসক চক্র খুব সচেতনভাবে মানুষের মাঝে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেয়। শাসকরা গদিকে রক্ষা করার জন্য জাতিতে-জাতিতে, ধর্মে-ধর্মে বিভেদ তৈরি করে শুধুমাত্র নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য। আর এর জন্য কড়া মূল্য দিতে হয় সাধারণ ধর্মবিশ্বাসী মানুষদেরকে। নজরুলের আমৃত্যু সংগ্রাম ছিল এই শাসক-শোষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে, এই ভন্ড-ধার্মিকদের বিরুদ্ধে। এদের বিরুদ্ধে বলেছেন, ‘হিন্দু-মুসলমানের দিনরাত হানাহানি, জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ, যুদ্ধবিগ্রহ, মানুষের জীবনে একদিকে কঠোর দারিদ্র্য, ঋণ, অভাব – অন্যদিকে লোভী অসুরের যক্ষের ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা পাষাণ-স্তূপের মতো জমা হয়ে আছে – এই অসাম্য, এই ভেদ-জ্ঞান দূর করতেই আমি এসেছিলাম। আমার কাব্যে, সংগীতে, কর্মজীবনে অভেদ-সুন্দর সাম্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে’।

কাজী নজরুল ইসলাম, মানুষের ধর্মকে বড় করে দেখেছেন আজীবন। তিনি চেয়েছেন মানুষের কল্যাণ, সমাজের মঙ্গল, স্বদেশের স্বাধীনতা। তাই হিন্দু কিংবা মুসলমান নয়, মানুষ হিসেবেই দেখেছেন। তিনি চেয়েছেন সাম্যবাদী সমাজের, যেখানে নেই শোষণ, বৈষম্য আর সাম্প্রদায়িকতার কোনো বিভেদ। এজন্যই তিনি লিখেছেন, ‘গাহি সাম্যের গান –যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান, যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রীশ্চান’।

কাজী নজরুল ইসলামের অসাম্প্রদায়িক গান বা কবিতার কারণে সবসময় তিনি ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু ছিলেন। মুসলমানরা বিভ্রান্ত হয়েছেন তার সৃষ্টিতেদেব-দেবীদের আরাধনা দেখে, আবার হিন্দুরা ক্ষ্যাপেছেন যখন তিনি বলেছেন, “আমি বিদ্রোহী ভৃত্য, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদচিহ্ন।” এই নজরুলই আবার কালীকে নিয়ে শ্যামাসংগীতলিখেছেন, “কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন। (তার) রূপ দেখে দেয় বুক পেতে শিব যার হাতে মরণ বাঁচন।” আবার রসুলকে নিয়ে লিখেছেন, “তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে। মধু পূর্ণিমারই সেথা চাঁদ দোলে। যেন ঊষার কোলে রাঙ্গা রবি দোলে।”

তিনি মুসলিম ঐতিহ্য বিষয়ক কবিতা কামাল পাশা, খেয়াপারের তরণী, মহরম, শাত-ইল-আরব, আনোয়ার, কাব্য আমপারা, ঈদ মোবারক, ফাতেহা-ই-ইয়াজদহম লিখেছেন আবার পাশাপাশি লিখেছেন হিন্দু ঐতিহ্য বিষয়ক কবিতা, আনন্দময়ীর আগমন, পূজারিণী, রক্তাম্বরধারিণী মা, আগমনী ও পূজা-অভিনয়। বিজয়া এবং হরপ্রিয়া নামে লিখেছেন দু’টো নাটক। লিখেছেন অজস্র ইসলামী গান ও শ্যামা সঙ্গীত। এর জন্য তাকে কম ধকল সহ্য করতে হয়নি। ইসলামী গান লেখার জন্য যেমন তৎকালের কট্টর হিন্দুত্ববাদীদের রোষানলে পড়েছিলেন তিনি, পাশাপাশি শ্যামা সঙ্গীত রচনার জন্য মোল্লা-মৌলবীদের আক্রোশেও পড়তে হয়েছে।

মক্তব, মাজার, মসজিদে বড় হলেও বালক বয়সেই লোকনাট্য লেটোদলে যোগদান করেন। নজরুলের কবি ও শিল্পী জীবনের শুরু এই লেটোদল থেকে। তাৎক্ষণিক গান ও কবিতা লেখার কৌশল তিনি এখান থেকেই রপ্ত করেছিলেন। ১৯২৬-এর ২২ মে কৃষ্ণনগরে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির বার্ষিক সম্মেলনে নজরুল যে উদ্বোধন সংগীত পরিবেশন করেন, তাতেও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে গর্জে ওঠেন। তখন হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গায় দেশ ক্ষত-বিক্ষত। নজরুল গানের মধ্য দিয়ে সাম্প্রদায়িক বিভেদের তীব্র বিরোধিতা করে গাইলেন ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’ সেই সংগীত। ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম? এই জিজ্ঞাসে কোন জন?/কাণ্ডারী! বলো ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র!’। মানুষের যখনমনুষত্ব নষ্ট হয়েছে, তখনই কবির মনে বিদ্রোহের সুর ধ্বনিত হয়েছে। যা বারংবার কবিতা, গানের মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়েছে।

বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’র সভায় বলেছিলেন, “বিংশ শতাব্দীর অসম্ভবের সম্ভাবনার যুগে আমি জন্মগ্রহণ করেছি। এরই অভিযান সেনাদলের তূর্য্যবাদকের একজন আমি- এই হোক আমার সবচেয়ে বড় পরিচয়। আমি এই দেশে, এই সমাজে জন্মেছি বলে, শুধু এই দেশেরই, এই সমাজেরই নই; আমি সকল দেশের, সকল মানুষের। কবি চায় না দান, কবি চায়অঞ্জলি। কবি চায় প্রীতি। কবিতা আর দেবতা সুন্দরের প্রকাশ। সুন্দরকে স্বীকার করতে হয়, যা সুন্দর তাই দিয়ে। সুন্দরের ধ্যান, তাঁর স্তবগানই আমার ধর্ম।”

সাম্প্রদায়িকতার উর্ধ্বে উঠে কবি নজরুল মানবতাকে সবার উপরে স্থান দিয়েছেন। তাঁর মতো করে আগে কেউ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় এভাবে মানবতার জয়গান করেনি। অসাম্প্রদায়িক চেতনা এবং মানবপ্রেম তাকে হিন্দু নয়, মুসলমান নয়, পরিণত করেছিল একজন মানুষ হিসেবে। সব ধর্মের ভেদাভেদ ভুলে মানবতার জয়গান গেয়েছেন। কবিতার মধ্য দিয়ে বলেছেন, ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান’।

বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৪ মে ১৯৭২ সালে কাজী নজরুল ইসলামকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। দেয়া হয় বাংলাদেশের ‘জাতীয় কবি’র স্বীকৃতি। আজ বিশ্ব মানবতার কবি, অসাম্প্রদায়িক চেতনার কবি, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন। শুভ জন্মদিনে জানাই অবনতমস্তকে বিনম্র শ্রদ্ধা।

লেখক: সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ ও সাবেক ছাত্রনেতা।

ইমেইল: haldertapas80@gmail.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *