নিজস্ব প্রতিবেদক, ধূমকেতু বাংলা: পঞ্চম বঙ্গবন্ধু সেন্ট্রাল সাউথ এশিয়ান আর্টিস্টিক জিমন্যাস্টিকস চ্যাম্পিয়নশিপের শুভেচ্ছাদূত হিসেবে এসেছেন বাংলাদেশে। ২৯ অক্টোবর প্রতিযোগিতার উদ্বোধন অনুষ্ঠানেও ছিলেন ২০১৬ সালে রিও অলিম্পিকে রিদমিক জিমন্যাস্টিকসে স্বর্ণ জেতা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত রাশিয়ান অ্যাথলেট মার্গারিটা। বাংলাদেশ জিমন্যাস্টিকস ফেডারেশন মার্গারিটাকে বিশেষ সংবর্ধনা প্রদান করে। নিজেকে অর্ধেক বাঙালি এবং অর্ধেক রাশান মনে করা মার্গারিটা তার বেড়ে ওঠা ও বাংলাদেশের জিমন্যাস্টিকস নিয়ে কথা বলেছেন।
আজ থেকে ঠিক ১৬ বছর আগে বাবা আব্দুল্লাহ আল মামুনের সঙ্গে শেষ বাংলাদেশে এসেছিলেন মার্গারিটা মামুন। তখন ১০ বছরের বেণি দোলানো ছোট্ট বালিকা মার্গারিটা। গ্রামে যা দেখতেন তাতেই অবাক চোখে তাকিয়ে থাকতেন। সেই অবাক বালিকা বিশ্বকে অবাক করে দিয়ে ২০১৬ সালে রিও অলিম্পিকে সোনা জিতে নেন রিদমিক জিমন্যাস্টিকসে। এরপর দীর্ঘ বিরতি শেষে এবার বাবার দেশে এলেন মা আনা ও স্বামী আলেক্সান্ডারকে নিয়ে। মার্গারিটার বাবা মামুনের বাড়ি রাজশাহীর দুর্গাপুরের কাশিপুর গ্রামে। সেই গ্রামে ছোটবেলায় একাধিকবার গিয়েছেন মার্গারিটা। আবারও যেতে চান। তবে বাবাকে ছাড়া বাবার গ্রামে যাওয়াটা তার জন্য বড্ড কষ্টের। বাবার কথা জানতে চাইলে মার্গারিটা বলেন, ‘আমার বাবা আব্দুল্লাহ আল মামুন ছিলেন মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। আর মা আনা সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। আমার মা সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হলেও তিনি পুরোপুরি গৃহবধূ। বাংলাদেশের কোনো কোনো মিডিয়ায় লেখা হয়েছে আমার মা রিদমিক জিমন্যাস্টিকস ছিলেন। এটি আসলে ঠিক নয়। অনেকে আবার বলেন বাবা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন; এটাও ঠিক নয়। বাবা আসলে দীর্ঘদিন ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলেন। অলিম্পিকে স্বর্ণ জয়ের এক সপ্তাহ পরই বাবা চলে যান না ফেরার দেশে। বাবাকে হারানোর কষ্ট বলে বোঝাতে পারব না!’
বাবার চাওয়া ও রাজশাহীর আম
বাবার স্বপ্ন ছিল আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মেয়ে কিছু করুক। ঠিকই বাবার সেই চাওয়া পূরণ করেছেন মার্গারিটা। রিও থেকে স্বর্ণপদক নিয়ে মস্কোয় ফেরার পর বাবা আব্দুল্লাহ আল মামুন খুশিতে আত্মহারা। কিন্তু সেই আনন্দ বেশি দিন স্থায়ী হলো না। কিছুদিন পর তা বেদনায় রূপ নেয়। হঠাৎই চলে যান তিনি না ফেরার দেশে। মার্গারিটা বলেন, ‘সে সময়টা আমাদের পরিবারের জন্য বেদনাদায়ক ছিল। বাবা হারানোর যন্ত্রণা এখনও আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়।’
বাবার কাছে মার্গারিটা শুনেছেন রাজশাহীর আমের কথা। কয়েকবার রাশিয়ায় তিনি আম নিয়েও গিয়েছেন। এখন বাবা নেই, তবে কেউ যদি ঢাকা থেকে মস্কো যান, মার্গারিটা তাকে আম নিয়ে যেতে বলেন। বাংলাদেশের খাবারে খুব একটা অভ্যস্ত হতে না পারলেও রাজশাহীর আম খুব পছন্দ তার।
অর্ধেক বাঙালি এবং অর্ধেক রাশান
মার্গারিটার জন্ম ও বেড়ে ওঠা সবই রাশিয়ায়। মা রাশিয়ান আর বাবা বাংলাদেশি; তাই তো মার্গারিটা মামুন নিজেকে হাফ রাশিয়ান এবং হাফ বাঙালি হিসেবেই মনে করে বলেন, ‘ছোটবেলায় যখন স্কুলে যেতাম, তখন যাদের সঙ্গে পড়তাম তারা সবাই ছিল রাশান। কেবল আমিই পুরোপুরি রাশান ছিলাম না। হাফ বাংলাদেশি এবং হাফ রাশিয়ান। স্কুল, জিমন্যাস্টিকস সেশন এবং আমার হাজবেন্ড সবাই আমাকে নিয়ে গর্ববোধ করে যে, আমি অর্ধেক বাঙালি এবং অর্ধেক রাশান। নিজেকে একজন বাঙালি ভাবতে আমি গর্ববোধ করি। বাবার কারণে আজ আমার হৃদয়েও বাংলাদেশ।’ শুধু তাই নয়, পৃথিবীর যেই প্রান্তেই গিয়েছেন তাকে দেখে বাংলাদেশিরা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসায় মুগ্ধ মার্গারিটা।
টোকিও অলিম্পিকে বাংলাদেশের অপেক্ষা
২০১৬ রিও অলিম্পিকের আগে এবং অলিম্পিকের আগেও বাংলাদেশে এসে মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন। অথচ তখন তিনি আলোচিত বা বিখ্যাত কেউ নন। রিও অলিম্পিকের পর তারকা বনে যাওয়ার পরও দেশে এসে মানুষের ভালোবাসায় মুগ্ধ মার্গারিটা। তার ভাষায়, ‘মস্কোয় বাংলাদেশি মানুষ যখনই আমাকে দেখত, দৌড়ে ছুটে আসত। টোকিও অলিম্পিকে যখন উদ্বোধন অনুষ্ঠান হচ্ছিল তখন বিভিন্ন দেশের মার্চপাস্ট হচ্ছিল, আমি অপেক্ষায় ছিলাম, কখন বাংলাদেশ দল মাঠে প্রবেশ করবে। যখনই দেখেছি বাংলাদেশের পতাকা হাতে ডেলিগেটরা মাঠে প্রবেশ করছেন, তখন আমার মধ্যে অন্যরকম এক অনুভূতি কাজ করছিল। আমি যখন কানাডায় ওয়ার্ল্ড কাপ খেলতে গিয়েছিলাম, সেখানেও দেখেছি বাংলাদেশের মানুষ আমার কাছে ছুটে এসেছে। আমি তাদের বলতে শুনেছি, তোমার বাবা বাংলাদেশি, তুমি বাঙালি। সত্যি কথা বলতে কী, যেখানে গিয়েছি বাংলাদেশি মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি।’
শুভেচ্ছাদূতের সেলফি
মার্গারিটা এবার বাংলাদেশে এসেছেন পঞ্চম বঙ্গবন্ধু সেন্ট্রাল সাউথ এশিয়ান আর্টিস্টিক জিমন্যাস্টিকস চ্যাম্পিয়নশিপের শুভেচ্ছাদূত হিসেবে। ২০১১ সালের পর অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া এ প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছে বাংলাদেশ জিমন্যাস্টিকস ফেডারেশন। ২৯ অক্টোবর প্রতিযোগিতার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেও ছিলেন মার্গারিটা। তার আগে সময় কাটানোর পাশাপাশি মিরপুর শহীদ সোহরাওয়ার্দী ইনডোর স্টেডিয়ামে বাংলাদেশি জিমন্যাস্টদের সঙ্গে পারফর্মও করেন মার্গারিটা। উৎফুল্ল জিমন্যাস্টদের সঙ্গে উচ্ছ্বসিত মার্গারিটা সেলফিও তোলেন। এবারের আসরে বাংলাদেশ ছাড়াও অংশ নিচ্ছে- নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভারত, উজবেকিস্তান ও পাকিস্তান। থাকছে ছয় দেশের ৬৭ জিমন্যাস্টসহ কোচ, জাজেজ, অফিসিয়ালসহ প্রায় ১৭৭ জন। তিন ক্যাটাগরিতে মোট ২২টি ইভেন্ট অনুষ্ঠিত হলেও বাংলাদেশের ১২ জন জিমন্যাস্ট অংশগ্রহণ করবেন তিনটি ইভেন্টে।
স্বপ্ন উড়ে লাল-সবুজে
বাংলাদেশ জিমন্যাস্টিকস ফেডারেশন মার্গারিটাকে দেয় বিশেষ সংবর্ধনা। স্বামী আলেক্সান্ডারের হাত ধরে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের মঞ্চে প্রবেশ করার পর অবাক মার্গারিটা মামুন। বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না, তার জন্য এত বড় আয়োজন। তাও তার বাবার প্রিয় বাংলাদেশে। মঞ্চের চারপাশে মার্গারিটার স্বর্ণজয়ী ছবি। লাল-সবুজে স্বপ্ন দেখা সোনার মেয়ে তো এমন সংবর্ধনা পেতেই পারে। বাংলাদেশের জিমন্যাস্টিকস নিয়েও স্বপ্ন দেখেন মার্গারিটা মামুন। হয়তো তার হাত ধরে একদিন অলিম্পিকের সোনা ঘরে তুলবে আমাদের আর্টিস্টিক জিমন্যাস্টিকসরাও!
আরো পড়ুন:
২৩ শিল্পপ্রতিষ্ঠান পেলো বঙ্গবন্ধু শিল্প পুরস্কার