নিখিল মানখিন, ধূমকেতু বাংলা: প্রতিরোধযোগ্য ও প্রতিকারযোগ্য চোখের অন্ধত্ব নিবারণে জনসচেতনতা গড়ে তোলার উপর জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, চক্ষু মানবদেহের অতি মূল্যবান অঙ্গ। এ অঙ্গের ক্রটি, জটিলতা, পুষ্টিহীনতা ও অজ্ঞতার কারণে মানুষ দৃষ্টিহীন হয়ে পড়ে। সাধারণ জনগণকে সচেতন ও অজ্ঞতা দূরীকরণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে।
আন্তর্জাতিক মেডিকেল জার্নাল ‘ল্যানসেট’ এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বের ১৮৮টি দেশের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০ কোটির বেশি মানুষ মাঝারি থেকে গুরুতর চোখের সমস্যায় ভুগছেন। ২০৫০ সালের মধ্যে এ ধরনের সমস্যায় আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ৫৫ কোটি ছাড়িয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
দক্ষিণ এশিয়ায় এক কোটি ১৭ লাখ, পূর্ব এশিয়ার ৬২ লাখ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ৩৫ লাখ, সাব-সাহারান আফ্রিকার মোট জনসংখ্যার ৪ শতাংশের বেশি মানুষ, পশ্চিম ইউরোপের মোট জনসংখ্যার প্রায় শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ অন্ধত্বের শিকার।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, দৃষ্টি সামান্য ঝাপসা হয়ে এলেও একজন মানুষের জীবনে যথেষ্ট বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। যেমন, বিষয়টি তাদের স্বাধীনতা সীমিত করে দিতে পারে, এ ধরনের সমস্যার কারণে তাদের অনেকে গাড়ি চালাতে পারেন না। তখন তাকে বাধ্য হয়েই গাড়ি চালানোর জন্য অন্যের ওপর নির্ভর করতে হয়। তাই এর সঙ্গে অর্থনৈতিক বিষয়টিও জড়িত। অন্ধত্ব প্রতিরোধ করার জন্য বিনিয়োগ করলে বিনিয়োগকারী দেশও লাভবান হবে। কারণ এই বিনিয়োগে আয় হবে বহুগুণ বেশি।
উন্নয়নশীল দেশগুলোতে খুব সহজেই এসব অন্ধত্ব প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব। এসব ব্যবস্থা একদিকে যেমন সস্তা, অন্যদিকে অবকাঠামোর প্রয়োজনও হয় খুব কম। আর অন্ধত্ব থেকে ফিরে আসা লোকজন আবার কাজে যোগ দিলে চিকিৎসা খরচও তুলে আনতে সক্ষম হবে। এসব দেশে চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতিসহ আরও বেশি সার্জন এবং সেবিকাদের প্রশিক্ষণ দেয়া প্রয়োজন, যাতে করে তারা চোখের টেকসই চিকিৎসাসেবা দিতে পারে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের(বিএসএমেএমইউ) উপাচার্য, চক্ষু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ ধূমকেতু বাংলাকে বলেন, সারা বিশ্বব্যাপী প্রায় ৩০০ মিলিয়ন মানুষের দৃষ্টিশক্তির স্বল্পতা আছে, এর মধ্যে ৩৯ মিলিয়ন ব্যক্তি যাদের বয়স পঞ্চাশের বেশি, তার মধ্যে ৮২ দশমিক ৫ শতাংশ লোক অন্ধ। তিনি বলেন, ভিশন ২০২০ প্রকল্পের লক্ষ্য ছিল ২০ বছরের মধ্যে আমরা অন্ধত্ব দূর করব। কিন্তু এখন সম্ভবত ২০৩০ বা ২০৫০ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে সম্পূর্ণ অন্ধত্ব দূরীকরণ করতে।
স্কুল শিক্ষার্থীদের ১৪ শতাংশের দৃষ্টিত্রুটি রয়েছে : গবেষণা প্রতিবেদন
দেশের স্কুল শিক্ষার্থীদের প্রতি ১০০ জনের মধ্যে প্রায় ১৪ জনের দৃষ্টিত্রুটি রয়েছে। এই শিশুদের চোখের ত্রুটি সংশোধনের জন্য চশমা ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকেরা। ঢাকা, বরিশাল, জামালপুর ও নওগাঁর বিভিন্ন স্কুলের ৩২ হাজার ৭৪৮টি শিশুর চোখ পরীক্ষা করে এই তথ্য জানিয়েছে ইস্পাহানি ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতাল। চলতি বছরের মে মাসে প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চার জেলার মধ্যে রাজধানী ঢাকার শিশুদের দৃষ্টিত্রুটির হার সবচেয়ে বেশি, প্রায় ৪০ শতাংশ।
গবেষকেরা জানান, পরীক্ষার আওতায় আসা শিশুদের প্রায় ১৪ শতাংশকে চশমা নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। সংখ্যায় তারা ৪ হাজার ৪২৯। এর মধ্যে ১ হাজার ৬৯৬টি শিশুকে তাৎক্ষণিক চশমা দেওয়া হয়। ২ হাজার ৭৩৩টি শিশুকে চশমা ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তার কথা জানিয়ে ইস্পাহানি ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালের স্থানীয় শাখায় পাঠানো হয়। কারণ, ওই শিশুদের চোখে ওষুধ দিয়ে বাড়তি পরীক্ষার প্রয়োজন ছিল। শিশুদের দূরে বা কাছে দুই ধরনের দৃষ্টিশক্তির সমস্যা দেখা দিতে পারে। চশমা দিয়ে সেই ত্রুটি দূর করা সম্ভব। এছাড়া কিছু শিশুর ‘লেজি আই’ বা দুর্বল চোখ হয়ে থাকে। ওই শিশুদের কম বয়সে দৃষ্টি কম থাকে। ১০ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের দৃষ্টিশক্তির উন্নয়ন হয়। কম বয়সে শিশুদের চিকিৎসা করালে পরিপূর্ণ দৃষ্টি ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। শিশুদের চোখের সুরক্ষায় ভিটামিন এ-যুক্ত খাবার নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
সচেতন হলে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধিতা বা অন্ধত্ব কমানো সম্ভব: বিশেষজ্ঞগণ
অন্ধত্ব নিবারণ করতে কয়েকটি বিষয়ের উপর জোর দিয়ে বিএসএমএমইউ উপাচার্য, চক্ষু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন বলেন, ছোট মাছ, শাকসবজি ও হলুদ ফলমুল খেলে চোখের দৃষ্টি বাড়ে। প্রতি ২০ মিনিট পর পর মোবাইল বা ল্যাপটপ বা টেলিভিশন দেখার পর ২০ ফুট দুরে ২০ সেকেন্ড তাকালে চোখের ব্যাথা ও মাথার ব্যাথা দূর হবে। প্রতিনিয়ত চোখের যত্ন নিতে হবে বা চোখের যত্নে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া বা চশমার প্রয়োজন আছে কিনা চোখের কোনো সমস্যা আছে কিনা এগুলো নিয়মিত চেকআপ করা দরকার।
কারো পরিবারের চোখের সমস্যা আছে কিনা পরিবারের কাছ থেকে জানতে হবে। পুষ্টিকর খাবার খাওয়া প্রয়োজন। নিয়মিত ব্যায়াম করা দরকার। যে সমস্ত খাবার খেলে ডায়াবেটিস হয়, ডায়াবেটিস রেটিনোপ্যাথি হয় সেসব খাবার বর্জন করা। ব্লাড প্রেসার স্বাভাবিক রাখা ও গ্লুকোমা পরীক্ষার জন্য ব্যবস্থা করতে হবে। প্রেসক্রিপশন মোতাবেক ঔষধ ব্যবহার করা উচিৎ। গ্লুকোমার ঔষধ নিয়মিত ব্যবহার করতে হয়। কোনো ফার্মেসি থেকে ওষুধ নিয়ে যখন-তখন ব্যবহার করলে চোখের প্রেসার বেড়ে যেতে পারে বা চোখের ক্ষতি হতে পারে। সে ক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ আবশ্যক। আমরা যদি ধূমপান থেকে বিরত থাকি তবে ক্যাটারাক্ট এবং অন্যান্য চোখের সমস্যা থেকে আমরা মুক্ত হতে পারব। আমরা চোখের প্রটেকশন করব, যাতে করে কোনো আঘাত না লাগে। এই অন্ধত্ব দূরীকরণে সবার তৎপর হওয়া উচিৎ।
জাতীয় চক্ষু ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. দ্বীন মোহাম্মদ নুরুল হক ধূমকেতু বাংলাকে জানান, বর্তমানে দেশে বছরে রোগীর চোখ অপারেশন করানোর সক্ষমতা ও চিকিৎসার মান কয়েকগুণ বেড়েছে। এ সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য সেবা নিশ্চিত করতে জাতীয় চক্ষু সেবা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
তিনি বলেন, চক্ষু মানবদেহের অতি মূল্যবান অঙ্গ। এ অঙ্গের ক্রটি, জটিলতা, পুষ্টিহীনতা, অজ্ঞতার কারণে মানুষ দৃষ্টিহীন হয়ে পড়ে। সাধারণ জনগণকে সচেতন ও অজ্ঞতা দূরীকরণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে।
ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ, চক্ষু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ ধূমকেতু বাংলাকে বলেন, মানুষ সচেতন হলে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধিতা বা অন্ধত্ব কমানো সম্ভব। চোখের পরিচর্যা বিষয়ে সাধারণ জ্ঞানের অভাব ও অসচেতনতার কারণে অনেক মানুষ চোখের নানা সমস্যায় ভুগছে এবং অনেকে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হয়ে পড়ছেন।
জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের রেটিনা বিভাগের অধ্যাপক ডা. দীপক নাগ বলেন, দেশে বর্তমানে চোখের উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা রয়েছে। চোখের ছানি চিকিৎসায় আমরা উন্নত বিশ্বের যে কোনো দেশের সমপর্যায় আছি। আমেরিকা বা ইউরোপ যে প্রযুক্তি আজ ব্যবহার করছে আমরা সেই একই প্রযুক্তি ব্যবহার করছি। অন্যান্য যেমন চোখের কসমেটিক সার্জারি, টেরা চোখ সোজা করা, চোখের পাতা নীচে পড়ে যাওয়া ইত্যাদি আমাদের দেশে এখন ভালো সার্জারি হচ্ছে। এখন থেকে ১০ বছর আগেও রেটিনার কোনো আলাদা বিভাগ ছিল না, বর্তমান আমাদের দেশে রেটিনা সেবার যথেষ্ট দক্ষ সার্জন আছেন।
তিনি বলেন, অস্ত্রোপচারের কারণে চোখে সমস্যা দেখা দিলে সমস্যা চিহ্নিত করে দ্রুত সঠিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করা গেলে চোখ হারানোর ঝুঁকি কমে আসে। তবে অস্ত্রোপচারের আগে চিকিৎসক ও সংশ্লিষ্টদের যত্নবান হতে হবে। কেউ যাতে অনুমাননির্ভর অস্ত্রোপচার না করেন, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
আরো পড়ুন: