ডেস্ক রিপোর্ট, ধূমকেতু বাংলা: বাংলাদেশের অনেক শিক্ষিত ও ডিগ্রিধারীরাই জমির কাগজপত্র ভালো করে বোঝেন না উল্লেখ্য করে যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ, মুহাম্মদ শাহাদত হোসেন বলেন-
“বাংলাদেশে প্রায় ৩৫ লাখ মামলা বিচারাধীন। প্রতি মামলায় সরাসরি পক্ষ— কমপক্ষে দুজন থেকে শুরু করে, কোনো কোনো মামলায় ২০০ জন বা তারও বেশি।
প্রতি মামলায় গড়ে ১৫ জন করে ধরলে বাংলাদেশে কোনো না কোনো মামলায় সরাসরি পক্ষ, এমন মানুষের সংখ্যা ৫ কোটির বেশি।
কেউ মামলায় জড়ালে, সে কেবল একা জড়ায় না, পরোক্ষভাবে তার পরিবারও জড়ায়। পরিবারকে গণনায় নিলে মামলার সঙ্গে সম্পর্কিত মানুষের সংখ্যা ১০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে বলে আমার অনুমান। এই সংখ্যাটা যদি কাছাকাছিও হয়, তার সহজ অর্থ— এ দেশের বেশিরভাগ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মামলা-মোকদ্দমার সঙ্গে জড়িত।
মামলা মানেই আইনের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়।
আইনের প্রাথমিক বিধান হলো— একজন ব্যক্তি নিজের মামলায় নিজে লড়বেন। না পারলে আইন জানা প্রতিনিধি, মানে আইনজীবী, তার পক্ষে লড়াই করবেন।
নিজে লড়ুক কিংবা আইনজীবীর মাধ্যমে লড়ুক, মামলার পক্ষদের আইন সম্পর্কে ধারণা থাকা জরুরী। বিচারক কিংবা আইনজীবীর পর্যায়ে আইনের জ্ঞান যদি নাও থাকে, সামগ্রিক বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞান অবশ্যই থাকা উচিত। নইলে অধিকার বঞ্চিত, ক্ষতিগ্রস্ত ও হয়রানির শিকার হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
এ দেশের বেশিরভাগ মামলা জমিসংক্রান্ত কিংবা জমি নিয়ে বিরোধ কেন্দ্র করে উদ্ভূত। অথচ জমি, দলিলপত্র, খতিয়ান, খাজনা-খারিজ বিষয়ে আমাদের তেমন জ্ঞান নেই। পড়াশোনা না জানাদের তো নাইই, বেশিরভাগ শিক্ষিতরাও এ বিষয়ে অজ্ঞ।
জমির কাগজাদিসংক্রান্ত খোঁজখবর সাধারণত বাপ চাচায় রাখেন সন্তানরা এ বিষয়ে খোঁজ রাখার প্রয়োজন মনে করেন না৷ বাপ-চাচা মারা গেলে হঠাৎ কোনো একজন একটি পুরনো দলিল এনে যখন জমি দাবি করে, সন্তানরা যায় বিপদে পড়ে। দীর্ঘদিনের দখলে থাকা জমি ছাড়বে কেন? আবার আইন অনুযায়ী করণীয় কি, তাও জানে না। ফলে সংঘাত অনিবার্য হয়। কথা কাটাকাটি থেকে মাথা ফাটাফাটি।
অথচ এ বিষয়ে আইনগত জ্ঞান থাকলে আলাপ করে মিমাংসা করতে পারতেন বা উপযুক্ত আইনগত পদক্ষেপ নিতে পারতেন। এদেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ মামলায় পড়েন এবং হয়রানির শিকার হন আইনগত জ্ঞানের অভাবে। ধারণা থেকে মিথ্যা মামলা করেন, কিংবা মিথ্যা মামলার শিকার হন। অন্যদের কথা বাদ দিলাম। উচ্চতর পড়াশোনা ও ডিগ্রি আছে, এমন আপনারা কতজন জমির কাগজপত্র বোঝেন? দলিল, খতিয়ানের হিসাব জানেন। খাজনা-খারিজের জ্ঞান রাখেন?
অথচ অনেকের বাবার জমি আছে, বাড়ি আছে বা অন্যান্য স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি আছে। পিতার অবর্তমানে আপনি ওই সম্পত্তির মালিক হবেন। অথচ তার খতিয়ান, দলিল, খাজনা বা প্রাসঙ্গিক আইনগত বিষয়ে আপনার ধারণা নেই। এই না জানা, ভবিষ্যতে আপনার বিপদের কারণ হতে পারে।
বাংলাদেশ সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদের বিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রের নাগরিক হিসাবে আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব চারটি। তার প্রথমটি হলো— সংবিধান ও আইন মেনে চলা। আর মানার পূর্বশর্ত হলো জানা।
অর্থাৎ সংবিধান ও আইন জানা কেবল ব্যক্তিগত প্রয়োজনে জরুরি নয়, নাগরিক থাকার শর্তও। এই বিধান সকল নাগরিকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ফলে আইন জানার দায় কেবল বিচারক আর আইনজীবীদের নয়, নাগরিকদেরও।
এখন প্রশ্ন হলো— নাগরিকগণ আইন জানবেন কি করে?
এই আয়োজন করে দেওয়ার প্রাথমিক দায়িত্ব রাষ্ট্রের। স্কুল পর্যায় থেকে উচ্চতর পর্যায়ে দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োজনীয় আইনগুলো একাডেমিক বিষয় হিসাবে সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত থাকা উচিত। উচ্চতর আইন ও আইনের জটিল ব্যাখ্যা পেশাদারদের জন্য থাকলেও, প্রাত্যহিক আইনের একটা সহজপাঠ স্কুল পর্যায় থেকে সিলেবাসে থাকা উচিত। সামগ্রিক বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কে নাগরিকদের অবশ্যই একটা পরিষ্কার ধারণা থাকা প্রয়োজন।
নাগরিকদের আইন মানা বাধ্যতামূলক করলে হবে না কেবল, জানার সুযোগও তৈরি করতে হবে”।
আরো পড়ুন:
জাকারবার্গকে ফেসবুকের অপব্যবহার বন্ধে বাংলাদেশী আইনজীবীর নোটিশ